Friday, 30 December 2016

অপরিকল্পিত পর্যটনে বিশ্ববিদ্যালয় যখন বিনোদন পার্ক


কয়েক সপ্তাহ ধরে এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের। এ বিপত্তি নিয়ে অনেক দৈনিক পত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মাধ্যমে যেমন ফলাও করে সংবাদ প্রচার হচ্ছে, তেমনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও সমান সোচ্চার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নীরব শান্তিপূর্ণ প্রতিবেশে নাগরিক কোলাহল কাঙ্ক্ষিত ছিল না। কিন্তু সম্প্রতি ঢাকার ব্যস্ত রাস্তার মতো ভয়াবহ যানজট জাহাঙ্গীরনগরের রাস্তায়। বলতে গেলে কিছু মুখস্থ উপমা যেমন— নগরজীবনের কোলাহলমুক্ত শান্ত নিবিড় পরিবেশে লাল ইটে মোড়ানো প্রকৃতির এক নান্দনিক সৌন্দর্যের মাঝে অবস্থিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, দেশের একমাত্র এই আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়টি সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ক্ষেত্রে একক বৈশিষ্ট্যের দাবিদার, ক্যাম্পাসের মুক্ত মঞ্চে সারা বছর বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নিয়ম করে প্রতি বছর শীত মৌসুমে অতিথি পাখির আগমন, লাল পদ্ম ফোটা লেকের জলে ডাহুকের ডুবসাঁতার, প্রত্যুষে কিংবা গোধূলি লগ্নে হরেক প্রজাতির পাখির কিচিরমিচির শব্দ, শীতের রাতে শিয়ালের হাঁকডাক, পিচঢালা রাস্তায় বীরের বেশে গুইসাপের স্বাধীনচেতা ঘোরাফেরা, ফুলে ফুলে প্রজাপতির ডানা মেলে ওড়াউড়ি, গাছের ডালে লক্ষ্মীপেঁচার অভিমানী শান্ত মুখ এ ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে বহুগুণ— এগুলোই করেছে সর্বনাশ। সবাই সৌন্দর্য আর সবুজের গল্প শুনে আগ্রহী হয়েছে। প্রত্যেকেই চাইছে নাগরিক কোলাহলমুক্ত হয়ে একটু শান্তির পরশ নিতে। আর তাতেই হুমকির মুখে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবেশ, ব্যাহত হচ্ছে এখানকার শিক্ষা কার্যক্রম। সবাই স্পষ্ট করে বলতে শুরু করেছেন, একটা আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় আর যা-ই হোক, বিনোদন পার্ক হতে পারে না।
প্রকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্ত-নির্জন পরিবেশ এখন অতিথি পাখির কিচিরমিচির শব্দে মুখর। পুরো ক্যাম্পাস যেন পরিযায়ী পাখির দখলে। হেমন্তের কুয়াশা আবৃত সকালে অতিথি পাখির কলকাকলিতে ঘুম ভাঙে ক্যাম্পাসবাসীর। ক্যাম্পাসের জলাশয়ে ১৯৮৮ সালের দিকে প্রথমবারের মতো অতিথি পাখি আসে। এর পর থেকে ক্যাম্পাসে প্রতি বছর নানা প্রজাতির অতিথি পাখি নিয়মিত আসে। এদের বেশির ভাগই হাঁসজাতীয় ও ক্যাম্পাসের লেকের পানিতে বসবাস করে। এর মধ্যে হাঁসজাতীয় সরালি, পাতারি হাঁস, পাতিতারা, গয়ার, বামুনিয়া হাঁস, বাড়িঘোরা, পান্তামুখী, ছোট জিরিয়া, চিতাটুপি, জলপিপি, পানকৌড়ি ইত্যাদি প্রধান। ২০০১ সালে প্রথমবার পরিবেশ ও প্রকৃতিকে বাঁচাতে জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য পাখিমেলা আয়োজন করা হয়। এর পর থেকে প্রতি বছর এ মেলার আয়োজন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ। প্রতি বছর সুদূর সাইবেরিয়া থেকে ক্যাম্পাসে আগত পরিযায়ী পাখি এবং প্রজাপতি সংরক্ষণে গণসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রাণিবিদ্যা বিভাগ কর্তৃক আয়োজিত ব্যতিক্রমী প্রজাপতি মেলা এখানকার পরিচিতিকে বিকশিত করেছে দেশব্যাপী, বয়ে এনেছে এক স্বতন্ত্র মর্যাদা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অনন্য নয়নাভিরাম সৌন্দর্য বর্তমানে ক্যাম্পাসবাসীর জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রকৃতির মাঝে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ার আশায় ক্যাম্পাসে ছুটির দিনে দর্শনার্থীদের ঢল নামে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার, বটলতা, ট্রান্সপোর্ট চত্বর, টারজান পয়েন্ট, ক্যাফেটেরিয়া, প্রজাপতি গবেষণা কেন্দ্র, সুইমিং পুল, বোটানিক্যাল গার্ডেনসহ প্রতিটি জায়গায় দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড়। গ্রীষ্ম ঋতুর তুলনায় শীতের সময়ে দর্শনার্থীর আগমন বেড়ে যায়। ক্যাম্পাসে শীতের পিঠা খেতে খেতে সুদূর সাইবেরিয়া থেকে আগত পাখিদের খুনসুটি, স্বচ্ছ জলে ফোটে থাকা লাল শাপলার সৌন্দর্য, হরেক প্রজাতির সবুজের মাঝে নগর জীবনে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে কার না ভালো লাগে! বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থানরত শিক্ষার্থীদের আতিথেয়তা ও উদার মনোভাব এবং নিরাপত্তা দর্শনার্থীদের জন্য এমন অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। বাঙালির এই আতিথ্য মনোভাব বংশজাত। আমাদের রক্তে মিশে আছে। হিন্দু ধর্মীয় শাস্ত্রে অতিথিকে দেবতা ‘নারায়ণ’-এর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। বাঙালির কাছে অতিথির মর্যাদা ও সম্মানের গুরুত্ব ঢের।
কিন্তু জাহাঙ্গীরনগরে দর্শনার্থীদের অবাধ বিচরণ ইদানীং রীতিমতো অত্যাচারে রূপ নিয়েছে। বিরক্ত হয়ে বর্তমানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অনেকেই ক্যাম্পাসে দর্শনার্থীদের বিশৃঙ্খল বিচরণে আপত্তি করছেন। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আপত্তির প্রধান কারণ, দর্শনার্থীদের অধিকাংশ ভুলে যান যে, এটা দেশের স্বনামধন্য একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। ক্যাম্পাসে আসা দর্শনার্থীদের চালচলন ও আচার-আচরণে মনে হয়, জাহাঙ্গীরনগর যেন পর্যটনকেন্দ্র! ক্যাম্পাসের যেখানে সেখানে গাড়ি পার্কিং, সংরক্ষিত অঞ্চলে অবাধ বিচরণ, উচ্চ শব্দে গাড়ির হর্ন বাজানো, যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা ফেলা, ছবি তোলার জন্য লেকের পানিতে ঢিল ছুড়ে পাখিদের উড়তে বাধ্য করা— এমন কর্মকাণ্ডে অবস্থানরত শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি ক্যাম্পাসের অবস্থা নাজেহাল। ক্যাম্পাসের সৌন্দর্যও দিন দিন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
এ অবস্থা চলতে থাকলে অতিথি পাখিরা ক্যাম্পাসকে অনিরাপদ মনে করবে এবং ভবিষ্যতে তাদের আর পদ্ম ফোটা লেকে দেখা যাবে না। প্রকৃতিক সৌন্দর্যও একপর্যায়ে বিনষ্ট হবে। ক্যাম্পাসে অহিংস্র প্রাণীর উপস্থিতি দিন দিন হ্রাস পাবে। প্রকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি নামে ক্যাম্পাসের যে খ্যাতি আছে, তা একদিন চিরতরে হারাবে। বর্তমানে শিক্ষার্থীদের জন্য সবচেয়ে বড় হয়ে উঠেছে খাবারের সমস্যা। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের উদাসীনতার কারণে হলগুলোর ডাইনিং ও ক্যান্টিনে নিম্নমানের খাবার। ফলে শিক্ষার্থীদের বৃহৎ অংশ বটতলার হোটেলের খাবারের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু ছুটির দিনে দর্শনার্থীদের বাড়তি চাপে হোটেলগুলোর খাবার দ্রুত শেষ হয়ে যায়। দোকানদাররা শিক্ষার্থীদের কাছে বাড়তি দাম দাবি করেন।
অধিক লাভের আশায় হোটেলের মালিকদের কাছে শিক্ষার্থীদের তুলনায় দর্শনার্থীরা বেশি গুরুত্ব পায়। খাবার না পেয়ে অনেক শিক্ষার্থীকে অনাহারে থাকতে হয়। এছাড়া উপচে পড়া মানুষের ভিড়ে, গাড়ির হর্ন, কোলাহল ও ধুলাবালি মিলে এমন বিশ্রী পরিবেশ সৃষ্টি হয় যেন মনে হয়, এটা কোনো আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় নয়, বাণিজ্যিক মেলা! এসব বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা প্রাণের ক্যাম্পাসের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাদের খুব বেশি উদ্বিগ্ন করে। এরই মধ্যে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষকদের মধ্যেও অনেকে ক্যাম্পাসের পরিবেশ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। জনৈক এক শিক্ষক তার ফেসবুকে লিখেছেন, ওয়েলকাম টু জাহাঙ্গীরনগর পার্ক! ক্যাম্পাসে দর্শনার্থী ঘুরতে আসবে এটা খুব স্বাভাবিক। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের এ বিষয়ে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু দর্শনার্থীদের মনে রাখতে হবে এটা আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়, কোনো পর্যটনকেন্দ্র নয়। তাদের ভদ্রতা বজায় রেখে সুন্দর ও শৃঙ্খলভাবে সৌন্দর্য উপভোগ করা উচিত।
আবাসিক এলাকায় জনসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকে। প্রবেশের অনুমতি থাকলেও নানা বিধিনিষেধ মেনে চলতে হয়। সেখানে একটা আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কীভাবে মানুষ এভাবে অবাধে প্রবেশ করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, তা আমার বোধগম্য নয়। এটি শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়, একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে শিক্ষকরা পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করেন। শিক্ষার্থীদের বৃহৎ অংশ আবাসিক হলগুলোয় অবস্থান করেন। সুতরাং এখানে শিক্ষা ও গবেষণার পরিবেশ বজায় রাখার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে নিরাপত্তাও নিশ্চিত করতে হবে। কিছুদিন আগের ঘটনা। রিকশা করে হলে যাওয়ার পথে সমাজবিজ্ঞান অনুষদের সামনে এক দর্শনার্থীর গাড়ির ধাক্কায় একজন মেয়ে মাটিতে ছিটকে পড়ে আহত হলো। ভাগ্যিস মারাত্মক কোনো বিপদ হয়নি। ক্যাম্পাসে এখন প্রায়ই এমন ছোটখাটো ঘটনা ঘটছে।
বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো দ্বীপ নয়। জাতীয় জীবনের সঙ্গে এর আন্তঃসম্পর্ক রয়েছে। দেশের সুনাম ক্ষুণ্ন ও উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করতে একটি গ্রুপ বিভিন্ন স্থানে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার বিষয়টি ভেবে হলেও ক্যাম্পাসে বাইরের মানুষের প্রবেশের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের সতর্ক হওয়া উচিত। আমাদের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়া উচিত। সমৃদ্ধ ভারত আর সোনার বাংলার গল্প শুনে সোনালি স্বপ্নে বিভোর ইউরোপীয়রা একদিন ভাস্কো দা গামার হাত ধরে আবিষ্কার করে ভারতে আসার পথ। তার পর বাকি গল্প কেবল আমাদের জন্য সর্বনাশের। অন্তত অনর্থক সুনামে মজে গিয়ে দেশের গুরুত্বপূর্ণ ও কাগজে-কলমে একমাত্র আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন সর্বনাশ ডেকে আনার সুযোগ নেই। প্রশাসনের উচিত এখনই সতর্ক পদক্ষেপ গ্রহণ করা। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক প্রতিবেশ আর শিক্ষার পরিবেশ অবাধ করতে বহিরাগতদের আগমন নিয়ন্ত্রণ এখন সময়ের দাবি। পাশাপাশি যারা বাইরে থেকে যাচ্ছেন, পুরো ক্যাম্পাস গাড়ি নিয়ে ঘুরে দূষিত করার বদলে উপযুক্ত গাড়ি পার্কিং ব্যবহারে তাদের বাধ্য করা উচিত। এক্ষেত্রে ক্যাম্পাস কর্তৃপক্ষ তাদের থেকে প্রয়োজনীয় টোল আদায় করার মধ্য দিয়ে উপকৃত হতে পারে। অন্যদিকে নির্দিষ্ট স্থানে গাড়ি রেখে পায়ে হেঁটে ভেতরে যাওয়ার ব্যবস্থা করে অহেতুক দর্শনার্থীর আগমনও কিছুটা কমিয়ে আনা সম্ভব।

Tuesday, 27 September 2016

ক্রিকেটাধিপত্য ও নারী ফুটবলারের লাঞ্ছনা

বাংলাদেশে নিছক কোনো খেলা নয়, বরং মাঝে মধ্যে উৎসবের উপলক্ষ হয়ে আসে এক একটি ক্রিকেট সিরিজ। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আমাদের সাফল্য যেমন অনুপ্রাণিত হওয়ার মতো, তেমনি ক্রিকেট দলের সঙ্গে বাহারি তকমা যুক্ত হয়েছে টিম-টাইগার্স। তবে ছেলেদের ফুটবল এদেশের যখন ক্রমশ জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে, ঠিক তখনই সম্পূর্ণ স্রোতের বিপরীতে গিয়ে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশের মেয়েরা গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপ ফুটবলের চূড়ান্ত পর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে। বাছাই পর্বে চীনা তাইপেকে ৪-২ গোলে হারিয়েছে। ২০১৭ সালে থাইল্যান্ডে মূলপর্বের খেলা অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশ দলের এ সফলতায় দেশবাসী আবেগাপ্লুত। দেশের জনগণ তাদের অভিনন্দন জানাতে কৃপণতা করেনি। এমনকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য গৌরবের উপলক্ষ নিয়ে আসা এই মেয়েদের প্রশংসা করেছেন। বলতে গেলে পর পর কয়েকটি ম্যাচ জেতার পর বাংলার আকাশে-বাতাসে অনূর্ধ্ব-১৬ নারী ফুটবলারদের জয়ধ্বনি। কিন্তু সবার এই আবেগ যে ক্ষণস্থায়ী, নিছক লোক দেখানো, তা বুঝতে খুব বেশি দেরি করতে হয়নি ইতিহাস সৃষ্টিকারী নারী ফুটবলারদের।
বাংলাদেশের ফুটবল যেখানে সময়ের আবর্তে ব্রাত্য, ছেলেদের ফুটবলে একের পর এক পরাজয় যখন আমাদের থমকে দিয়েছে, তখন এই মেয়েরা বলতে গেলে আমাদের নিভে যেতে থাকা আশার প্রদীপ নতুন করে জ্বালিয়েছে। তবে এত বড় একটা অর্জনের পর কৃষ্ণা-মারিয়া-সানজিদাদের ঈদে বাড়ি যেতে লোকাল বাসের যাত্রী হতে হয়েছে। এ বাসের যাত্রী হয়ে যাত্রাপথে পদে পদে লাঞ্ছিত, অপমানিত ও অশ্লীল বাক্যের শিকার হন তারা। বাংলাদেশের একজন ক্রিকেটারকে নিয়ে যতটা চিন্তা করা হয়, তাদের নিরাপত্তা, সম্মান আর সামাজিক স্ট্যাটাস যতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, সেখানে পুরো দৈন্য দেখা গেছে এদের ক্ষেত্রে। বিশেষ করে পুরো টিমকে মাঝ রাস্তায় ছেড়ে দেয়া হয়। তাদের সঙ্গে ছিল না ফুটবল ফেডারেশনের কোনো কর্মকর্তা, এমনকি তাদের যাত্রা নির্বিঘ্ন করতেও বাংলাদেশে ফুটবল ফেডারেশন থেকে নেয়া হয়নি কোনো বিশেষ পদক্ষেপ।
এটা অনাকাঙ্খিত যে এত বড় অর্জনের পরেও ফুটবল ফেডারেশন থেকে তাদের প্রতি ঈপ্সিত সম্মানটুকু দেখানো হয়নি। ঈদের আগে পথে-ঘাটে যত রকমের দুর্ভোগ থাকে, সব ধরনের দুর্ভোগ, কটুবাক্য ও অপমান সহ্য করে বাড়ি পৌঁছেও তাদের অভিজ্ঞতা ভালো হয়নি। কলসিন্দুর গ্রামে ফুটবলার তাসলিমার বাবাকে পিটিয়েছেন এক স্কুলশিক্ষক। দেশের হয়ে খেলা কলসিন্দুরের সব মেয়েকে ঢাকার সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ না দিয়ে স্কুলের হয়ে খেলার আদেশ দিয়েছিলেন ওই শিক্ষক। কিন্তু মেয়েরা তার কথা শুনেনি। এ কারণেই নাকি প্রথমে তাসলিমাকে গালাগাল এবং পরে তার বাবাকে মারধর করা হয়! কিন্তু দেশের জন্য এত বড় সম্মান বয়ে আনার ঠিক পর পরই পদে পদে লাঞ্ছনা ও অপমান কি তাদের কাঙ্ক্ষিত ছিল? এই কি তাদের জন্য আমাদের উপহার? আর শুরুতে তাদের প্রতি দেশবাসীর যে উচ্ছসিত ভালোবাসা, তা এত দ্রুত উবে গেল? তাই ভোগান্তির শিকার এক ফুটবলার টিভি ক্যামেরার সামনে জানালেন তার যন্ত্রণার কথা ঠিক এভবেই, ‘সুন্দর একটা রেজাল্ট করলাম আমরা, বাংলাদেশের হয়ে খেললাম কিন্তু আজকে...খুব কষ্ট লাগছে। বাসের মধ্যে যাত্রীদের কাছে এভাবে অপমান, লাঞ্ছনা ও ভোগান্তির শিকার হতে হবে তা কখনই ভাবিনি।’
দেশের প্রেক্ষাপটে এ হতাশা শুধু একজন খেলোয়াড়ের নয়, এ হতাশা একজন নারীরও। পাবলিক বাসে, রাস্তায় চলার পথে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রায় প্রতিটি স্থানে নারীরা ইভ টিজিং থেকে শুরু করে নানা বঞ্চনার শিকার হন। তবে আপাতত মারিয়া-সানজিদাদের নারী হিসেবে নয়, খেলোয়াড় হিসেবে বিবেচনা করে কয়েকটি প্রশ্ন উত্থাপন করা যেতেই পারে। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, যেখানে আমাদের ক্রিকেটাররা ইচ্ছেখুশি নিজের গাড়ি হাঁকিয়ে বেড়ান, কেউ কেউ নিয়মিত হেলিকপ্টারে পর্যন্ত চড়েন, সেখানে দেশের জন্য এমন সম্মান বয়ে আনা মেয়েগুলো কেন লোকাল বাসের যাত্রী হয়ে ঈদ করতে বাড়ি যাবে? কেন পথিমধ্যে তাদের কটুবাক্য শুনতে হবে? কেন তাদের প্রতি কর্তৃপক্ষের এমন উদাসীনতা ও অবহেলা? তারা কি একটু বিশেষ সুযোগ-সুবিধা, নিরাপত্তা, সম্মান প্রত্যাশা করে না?
বাফুফের এমন নির্বোধ কর্মকাণ্ডে যারপরনাই বিরক্ত হয়েছি। অন্তত এজন্যই আর বলতে দ্বিধা নেই, দেশে একমাত্র ক্রিকেটার বাদে অন্য প্রায় সব খেলোয়াড় অবহেলিত। তাদের তেমন গুরুত্ব দেয়া হয় না। ক্রিকেটারদের মতো যদিও দেশের অন্য খেলোয়াড়রাও লাল-সবুজের পতাকা বহন করেন। দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনেন, বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। তার পরও এরা প্রায় সময়ই উপেক্ষিত।
আমাদের মানতেই হবে বিশ্বক্রিকেটে বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম এখন শক্ত অবস্থানে। এ অর্জন একদিনে হয়নি। এর পেছনে রয়েছে খেলোয়াড়দের কঠোর শ্রম, ত্যাগ ও নিষ্ঠা। আর দেশ ও দেশের জনগণের পৃষ্ঠপোষকতা। দেশে ক্রিকেটকে যে পরিমাণে সাপোর্ট দেয়া হয়, অন্য কোনো খেলায় তা দেয়া হয় না। দিনের পর দিন ক্রিকেটের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার মুখে অচ্ছুত-অবহেলিত হয়ে যাচ্ছে অন্য সব ধরনের খেলা। আমাদের জাতীয় খেলা কাবাডি থেকে শুরু করে ফুটবল, হকি, অ্যাথলেটিকস এগুলোয় কারো কোনো দৃষ্টিই যেন নেই। আমরা জানি, ক্রিকেট আজকের অবস্থানে আসতে কতটা পৃষ্ঠপোষকতা দিতে হয়েছে। তাই দেশের অন্যান্য খেলা যদি এমন পৃষ্ঠপোষকতা পেত তাহলে হয়তো আমরা সেখান থেকেও ভালো কিছু উপহার পেতাম।
বাংলাদেশের বিভিন্ন দৈনিক বাঙালি-রাশিয়ান মেয়ে মার্গারিটা মামুনকে নিয়ে মেতে আছে। কিন্তু এ মাতামাতির মধ্যে খোদ আমাদের দেশের মাটিতেই তার মতো আরো কয়েক ডজন ক্রীড়াবিদের জন্ম নেয়ার পথ রুদ্ধ করা হচ্ছে, সেদিকে কারো খেয়াল আছে কি? আমরা জানি, একমাত্র ক্রিকেটার বাদে বাকিরা কতটা অপর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার মধ্যে শুধু নিজ মেধা, দৈহিক সক্ষমতা ও যোগ্যতা দিয়ে জাতীয় পর্যায় থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক আসরে প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। তারা যেভাবে এই অপর্যাপ্ত সুবিধার মধ্যেও দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনেন তা-ইবা কম কিসে! সম্প্রতি অনুষ্ঠিত রিও অলিম্পিকে বাংলাদেশ থেকে সাতজন খেলোয়াড় অংশগ্রহণ করেছেন। এর মধ্যে একজন সাঁতারু মাহফিজুর রহমান সাগর। অলিম্পিক থেকে দেশে ফিরে বাড়ি যাওয়ার পথে ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন তিনি। গণমাধ্যমে এ সংবাদ প্রকাশ না হলেও ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে ঘটনাটি আমি জানি। এই হচ্ছে দেশের একজন খেলোয়াড়ের নিরাপত্তা অবস্থা! গত লন্ডন অলিম্পিকে এই মাহফিজুর রহমান সাগরই বাংলাদেশের পতাকা বহন করেছিলেন। খেলোয়াড়রা দেশের প্রতিনিধি। লাল-সবুজের পতাকা তারা বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেন। এসবের বিনিময়ে তারা আমাদের কাছে কিছু চান না। কিন্তু কৃতজ্ঞ জাতি হিসেবে আমরা তাদের প্রতি একটু সম্মান তো দেখাতে পারি। এটা আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। অথচ দেশের মাটিতে মারিয়া-সানজিদাদের অপমানিত হতে হয়। দেশসেরা সাঁতারু মাহফিজুর রহমান সাগর অলিম্পিক থেকে দেশে এসে বাড়ি ফেরার পথে ছিনতাইয়ের শিকার হন। বিষয়গুলো ভাবতেই লজ্জা লাগে। আমাদের মানসিক দৈন্য কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে! নিঃসন্দেহে এ দৈন্য হতাশার জন্ম দেয়। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন, যে দেশে গুণীর কদর নেই, সে দেশে গুণী জন্মাতে পারে না। আর অনাগত সময় এমনই এক ভয়াবহতারই ইঙ্গিত দিচ্ছে আমাদের। আগে থেকে সতর্ক না হলে বাংলাদেশে একমাত্র ক্রিকেট বাদে আর কোনো খেলাধুলায় কারো আগ্রহ থাকবে বলে মনে হয় না। তখন বিশ্বের সব দেশ অলিম্পিক থেকে মেডেলের পসরা নিয়ে ঘরে যাবে, আর দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে আমাদের অসহায়ত্বের প্রহর।
এই লেখাটি বণিক বার্তা পত্রিকায় ২৭/০৯/২০১৬ ইং প্রকাশিত।

Monday, 19 September 2016

রক্ত দিয়েই দৃঢ় হোক বন্ধন

শ্রাবণের পড়ন্ত বিকেলে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। নৈসর্গিক সৌন্দর্যের মাঝে এক শান্ত নীরবতা। এমন মন ভুলানো আবেশে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আড্ডাস্থল খ্যাত ট্রান্সপোর্ট চত্বরের পাশে লাল ইটের গাঁথুনিতে গড়া বাঁধন অফিসে কিছু শিক্ষার্থী আড্ডায় মশগুল। প্রতিদিনই পৃথিবীর বুকে সন্ধ্যা নামার আগে ওরা এখানে এসে মিলিত হয়। একে অন্যের সঙ্গে খোশগল্পে মেতে ওঠে। কিন্তু আড্ডা দেওয়া তাদের মূল উদ্দেশ্য নয়। সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে, বিবেকের তাড়নায়, বিপদগ্রস্ত মানুষকে সেবাদানের মানসিকতা নিয়ে বাঁধন অফিসে প্রতিদিনই এরা উপস্থিত হয়। আড্ডার মাঝখানে রুক্ষ চুলের জীর্ণ পোশাক পরিহিত এক ব্যক্তি হাজির। চোখেমুখে তাঁর দুশ্চিন্তায় স্পষ্ট ছাপ। তাঁর সহধর্মিণী হাসপাতালে শয্যাগত। আজ রাতেই স্ত্রীর অপারেশন হবে। এ জন্য দুই ব্যাগ ও নেগেটিভ রক্তের প্রয়োজন। কিন্তু কোথাও তিনি রক্ত খুঁজে পাচ্ছেন না। তাঁর আর্থিক সামর্থ্যও নেই কোন ব্লাড ব্যাংক থেকে রক্ত কিনবেন। জাবি বাঁধন অফিসে এসেছেন রক্তের সন্ধানে। প্রতিদিনই এমন অসংখ্য মানুষ রক্তের প্রয়োজনে ছুটে আসে এখানে। এটি শুধু জাবি বাঁধন শাখার প্রাত্যহিক চিত্র নয়। দেশের প্রতিটি বাঁধন কেন্দ্রে এমন অসংখ্য মানুষ প্রতিদিনই রক্তের প্রয়োজনে আসে এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বাঁধনকর্মীদের দ্বারা উপকৃত হয়।
স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের দ্বারা পরিচালিত স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের একটি সংগঠন ‘বাঁধন’। এটি সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক ও অরাজনৈতিক একটি স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক সংগঠন। এই সংগঠনের কর্মীরা স্বেচ্ছায় রক্তদানে উদ্বুদ্ধকরণের জন্য নবীন শিক্ষার্থীদের রক্তদানের উপকারিতা সম্পর্কে অবহিত করে। সচেতনতামূলক পোস্টারিংয়ের আয়োজন করে। প্রতিবছর রক্তদাতাদের জন্য ডোনার সংবর্ধনার আয়োজন করে। এসবের পাশাপাশি সংগঠনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বিভিন্ন সেবা প্রদান ও জনগণের মধ্যে অজ্ঞতা দূর করে নানাবিধ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে সুস্থ সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে তারা।
প্রায় ১৯ বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলে ‘বাঁধন’-এর জন্ম। বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ, পিজি হাসপাতাল ও বারডেমসহ বেশ কিছু চিকিৎসাকেন্দ্রের অবস্থান হওয়ায় প্রায় প্রতিদিনই জরুরি রক্তের প্রয়োজনে অনেকেই ছাত্রাবাসে রক্তের সন্ধান আসত। ছাত্রাবাসের গেটে এসে রক্তের প্রয়োজনে অনেকে কান্নাকাটি করত। কখনো রোগীর আত্মীয়স্বজন হল গেটে ‘রক্ত চাই’ শিরোনামে নোটিশ লাগিয়ে দিত। ভাগ্যগুণে অনেকে রোগীর জন্য প্রয়োজনীয় রক্ত পেত। অনেকে ব্যর্থ হয়ে হতাশ হয়ে ফিরে যেত। বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য ছাত্রছাত্রী পরিচিত/অপরিচিত অনেক রোগীর জন্য প্রায়ই স্বেচ্ছায় রক্তদান করত। কিন্তু এই রক্তদান সীমাবদ্ধ ছিল। কারণ বেশির ভাগ শিক্ষার্থী তখন নিজের রক্তের গ্রুপই জানত না। নিয়মিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর শিক্ষার্থীদের স্বেচ্ছায় রক্তদান কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত রাখার মতো কোনো কাঠামোগত সাংগঠনিক উদ্যোগও ছিল না। ঠিক সেই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যারয়ের কিছুসংখ্যক শিক্ষার্থী ব্যক্তিগত উদ্যোগে বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর তাগিদ অনুভব করে। ১৯৯৭ সালে শহীদুল্লাহ হলের একজন আবাসিক ছাত্র তাঁর বন্ধুদের কাছে স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের একটি সংগঠন খোলার প্রস্তাব রাখেন। মহৎ এ প্রস্তাবে সবাই রাজি হয়। হলের একটি কক্ষে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর সংগঠনটির একটি নাম চাওয়া হয় সবার কাছে। কয়েকটি প্রস্তাবিত নামের মধ্য থেকে একটি নাম ‘বন্ধন’ সবার পছন্দ হয়। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক ছাত্রদের একটি সংগঠনের নাম বন্ধন থাকায় বন্ধনের অপভ্রংশ করে ‘বাঁধন’ নামটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।
বেশির ভাগ শিক্ষার্থী তখন তাদের রক্তের গ্রুপ জানে না। এ অবস্থায় সংগঠনের সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বিনা মূল্যে রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা করার ব্যবস্থা করা হবে। তারিখ নির্ধারিত হয় ১৯৯৭ সালের ২৪ অক্টোবর। দিনটি ছিল শুক্রবার। বাঁধনের ইতিহাসে ওই দিনটিই সংগঠনের আত্মপ্রকাশের দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। বিনা মূল্যে রক্তের গ্রুপ নির্ণয়ের মাধ্যমে সংগঠনটির আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ ঘটে। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব হলে অভিন্ন পদ্ধতিতে সংগঠনটির কার্যক্রম শুরু হয়। বিস্তৃতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সবার মধ্যে বৃহত্তর সাংগঠনিক যোগাযোগের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলে ১৯৯৮ সালের ৩১ অক্টোবর শাহিদুল ইসলাম রিপনকে আহ্বায়ক করে কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটি গঠিত হয়। এ কমিটি কয়েকটি নতুন ইউনিট খোলাসহ গঠনতন্ত্র প্রণয়ন ও পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় কমিটি নির্বাচন সম্পন্ন করে এবং ১৯৯৯ সালের ১০ আগস্ট নতুন কমিটির কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করে। এরপর থেকে নিয়মিতভাবে প্রতিবছর বাঁধনের কেন্দ্রীয়, জোনাল ও ইউনিট পর্যায়ে প্রায় ১২০টি কমিটি প্রতিবছর নতুন করে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় গঠিত হয়ে আসছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্কালীন উপাচার্য অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী টিএসসিতে বাঁধনের কেন্দ্রীয় অফিস হিসেবে একটি কক্ষ প্রদান করেন। অরাজনৈতিক সামাজিক সংগঠন হিসেবে বাঁধন সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে ২০০১ সালের ৮ জুন রেজিস্ট্রেশন সনদ লাভ করে। বর্তমানে বাঁধন দেশের ১৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, ৩৬টি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজসহ মোট ৫১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ১০০টি ইউনিট ও ১৫টি পরিবারের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের স্বেচ্ছায় রক্তদানে উদ্বুদ্ধ করে যাচ্ছে।
বাঁধনের প্রতিষ্ঠাতা শাহিদুল ইসলাম রিপন বলেন, ‘আমাদের দেশে প্রতিবছর অসংখ্য রোগী রক্তের অভাবে মারা যায়। অসংখ্য রক্তদাতা থাকা সত্ত্বেও প্রয়োজনে সময়মতো রক্ত পাওয়া যায় না, ক্ষেত্রবিশেষে অসম্ভবও বটে। বাঁধন প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ অবস্থার অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানে রক্তের অভাবে কোনো অসহায় দুস্থ রোগীর জীবন প্রদীপ নিভে যায় না। আজ অসহায় দুস্থ মুমূর্ষু রোগীর রক্তের প্রয়োজনে বাঁধন একটি নির্ভরতার নাম।’
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. আজম বলেন, ‘বাঁধন আগামী ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় এর কার্যক্রম চালু করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। স্বেচ্ছায় রক্তদানে শরীরের কোনো ক্ষতি হয় না, এই বার্তাটি আমরা সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে চাই। জনমনে এ সচেতনতা সৃষ্টি করতে পারলেই আমাদের স্বপ্ন পূরণ হবে। শহীদের রক্ত দিয়ে অর্জিত এই মাতৃভূমির বুকে রক্তের অভাবে আর একটি মানুষেরও জীবনের বাতি যেন নিভে না যায়।’

Monday, 12 September 2016

কলসিন্দুরের নারী ফুটবলার ও আমাদের মানসিক দৈন্যতা।

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এএফসি অনুর্ধ্ব-১৬ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশের মেয়েরা গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যা​ম্পিয়নশিপ ফুটবলের চূড়ান্তপর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে। বাছাইপর্বে চীনা টাইপেকে ৪-২ গোলে হারিয়েছে। ২০১৭ সালে থাইল্যান্ডের মূল পর্বের খেলা অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশ দলের এই সফলতার দেশবাসী আবেগে আপ্লুত। দেশের জনগণ তাদের অভিনন্দন জানাতে কৃপণতা করেনি। বাংলার আকাশে বাতাসে  অনুর্ধ্ব-১৬ নারী ফুটবলারদের জয়ধ্বনি। কিন্তু বাঙালির এ আবেগ যে ক্ষণস্থায়ী, নিছক লোক দেখানো তা বুঝতে খুব বেশি দেরি করতে হয়নি ইতিহাস সৃষ্টকারী নারী ফুটবলারদের। মাত্র দু'দিনের ব্যবধানে বাঙালি তাদের প্রাপ্য বুঝিয়ে দিয়েছে! এত বড় একটা অর্জনের পর মারিয়া সানজিদাদের ঈদে বাড়ি যেতে লোকাল বাসের যাত্রী হতে হয়েছে। শুধু তাই নয়, যাত্রা পথে হতে হয়েছে লাঞ্ছিত, অপমানিত ও অশ্লীল বাক্যের শিকার। তাদের সাথে ছিল না ফুটবল ফেডারেশনের কোন কর্মকর্তা, এমনকি তাদের যাত্রা নির্বিঘ্ন করতে ফেডারেশন থেকে নেয়া হয়নি কোন পদক্ষেপ। ফেডারেশন থেকে যদি একটা মাইক্রোবাস ভাড়া করেও তাদের বাড়ি পাঠানোর উদ্যোগ নিতো, তাহলেও কিন্তু মেয়েগুলোর এভাবে পথে অপমানিত হতে হয় না। দুঃখজনক এত বড় অর্জনের পরেও ফুটবল ফেডারেশন থেকে তাদের প্রতি নূন্যতম ভদ্রতা দেখানো হয়নি। ঈদের আগে পথেঘাটে যত রকমের দুর্ভোগ থাকে সব ধরনের দুর্ভোগ, কটুবাক্য ও অপমান সহ্য করে বাড়ি পৌঁছেও তাদের অভিজ্ঞতা ভালো হয়নি। কলসিন্দুর গ্রামে ফুটবলার তাসলিমার বাবাকে পিটিয়েছে এক স্কুলশিক্ষক৷ দেশের হয়ে খেলা কলসিন্দুরের সব মেয়েকে ঢাকার সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ না দিয়ে স্কুলের হয়ে খেলার আদেশ দিয়েছিলেন ঐ স্কুলশিক্ষক৷ কিন্তু মেয়েরা তাঁর কথা শুনেনি। এ কারণেই নাকি প্রথমে মেয়েকে গালাগাল এবং তারপর তাঁর বাবাকে মারধর! পত্রিকায় পড়লাম স্কুল থেকেও নাকি তাদের বিতাড়িত করা হবে! দেশের জন্য এত বড় সম্মান বয়ে আনার পর প্রতিটি পদে পদে লাঞ্ছনা ও অপমান। এই হচ্ছে তাদের উপহার! তাদের প্রতি বাঙালির ভালোবাসা! "এত সুন্দর একটা রেজাল্ট করলাম আমরা, বাংলাদেশের হয়ে খেললাম কিন্তু আজকে.........খুব কষ্ট লাগছে।" বাসের মধ্যে যাত্রীদের কাছে অপমান, লাঞ্ছনা ও ভোগান্তির শিকার হয়ে টিভি ক্যামেরার সামনে কথাগুলো বলেছেন কলসিন্দুরের এক নারী ফুটবলার। দেশের প্রেক্ষাপটে এ হতাশা শুধু একজন খেলোয়ারের না, এ হতাশা একজন নারীর। পাবলিক বাসে, রাস্তায় চলার পথে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রায় প্রতিটি স্থানেই নারীরা ইভটিজিং এর শিকার হয়। অপমান ও লাঞ্ছনার শিকার হয়ে অনেকে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চিরবিদায় নিতে বাধ্য হয়। যাইহোক, এ বিষয়ে আলোচনায় যাবো না। আপাতত মারিয়া সানজিদাদের নারী হিসেবে না, খেলোয়ার হিসেবে বিবেচনা করে কয়েকটি প্রশ্ন করতে চাই। দেশের জন্য এমন সম্মান বয়ে আনা মেয়েগুলো কেন লোকাল বাসের যাত্রী হয়ে ঈদ করতে বাড়ি যাবে? কেন পথমধ্যে তাঁরা কটুবাক্যের শিকার হবে? কেন তাদের প্রতি কর্তৃপক্ষের এমন উদাসীনতা ও অবহেলা ? তাঁরা কী একটু বিশেষ সুযোগ - সুবিধা, নিরাপত্তা, সম্মান প্রত্যাশা করে না? বাফুফের এমন কান্ডজ্ঞানহীন কর্মকাণ্ডে যারপরনাই বিরক্ত হয়েছি। বলতে দ্বিধা নেই দেশে একমাত্র ক্রিকেটার বাদে অন্যান্য প্রায় সকল খেলোয়ার অবহেলিত। তাদের তেমন গুরুত্ব দেয়া হয় না। ক্রিকেটারদের মত যদিও দেশের অন্যান্য খেলোয়াররাও লাল সবুজের পতাকা বহন করেন। দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনেন, বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। কিন্তু তারপরও এরা প্রায় সময়ই উপেক্ষিত। ক্রিকেটার বাদে অন্যান্য খেলোয়ারদের জন্য বিমানবন্দরে কেউ ফুলের মালা নিয়ে অপেক্ষায় থাকে না ; তাদের অর্জনের জন্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বিশেষ কোন উপহার ঘোষণা করা হয় না। অস্বীকার করছি না দেশের অন্যান্য খেলার তুলনায় ক্রিকেট অনেক দূরে এগিয়ে গেছে। বিশ্ব ক্রিকেটে বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম এখন শক্ত অবস্থানে। এ অর্জন একদিনের না। এর পিছে রয়েছে খেলোয়ারদের কঠোর শ্রম, ত্যাগ ও নিষ্ঠা। আর দেশ ও দেশের জনগণের পৃষ্ঠপোষকতা। দেশে ক্রিকেটকে যে পরিমাণে সাপোর্ট দেয়া হয় অন্যান্য কোন খেলায় তা দেয়া হয় না। দেশে অন্যান্য খেলা যদি এমন পৃষ্ঠপোষকতা পেতো তাহলে হয়ত আমরা সেখান থেকেও ভালো কিছু উপহার পেতাম। অপর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার মাঝেও এরা নিজ মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে আন্তর্জাতিক আসরে প্রতিযোগিতা করে। দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনে। এই বা কম কিসে! সম্প্রতি অনুষ্ঠিত রিও অলিম্পিকে বাংলাদেশ থেকে সাতজন খেলোয়ার অংশগ্রহণ করেছেন। এর মধ্যে একজন সাঁতারু মাহফিজুর রহমান সাগর। অলিম্পিক থেকে দেশে ফিরে বাড়ি যাওয়ার পথে ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন। গণমাধ্যমে এ সংবাদ প্রকাশিত না হলেও ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে ঘটনাটি আমি জানি। এই হচ্ছে দেশের একজন খেলোয়ারের নিরাপত্তা অবস্থা! গত লন্ডন অলিম্পিকে এই মাহফিজুর রহমান সাগর -ই  বাংলাদেশের পতাকা বহন করেছিলেন। খেলোয়াররা দেশের প্রতিনিধি। লাল সবুজের পতাকা তাঁরা বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেন। এসবের বিনিময়ে তাঁরা আমাদের কাছে কিছু চান না। কিন্তু কৃতজ্ঞ জাতি হিসেবে আমরা তাদের প্রতি একটু সম্মান তো দেখাতে পারি। এটা আমাদের দায়িক্ত ও কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। অথচ দেশের মাটিতে মারিয়া সানজিদাদের অপমানিত হতে হয়। দেশসেরা সাঁতারু মাহফিজুর রহমান সাগর অলিম্পিক থেকে দেশে এসে বাড়ি ফেরার পথে ছিনতাইয়ের শিকার হন। বিষয়গুলো ভাবতেই লজ্জা লাগে। আমাদের মানসিক দৈন্যতা কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে! নিঃসন্দেহে এ দৈন্যদশা অবস্থা হতাশার জন্ম দেয়। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন, যে দেশে গুনীর কদর নেই সে দেশে গুনী জন্মাতে পারে না। ঘটে যাওয়া এমন কিছু ঘটনা বিশ্লেষন করলে বোঝা যায় আমাদের দেশে গুনীদের কদর আসলে কতটুকু!

Saturday, 10 September 2016

ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী :হারানো গৌরব ফিরে আসুক


গতকাল ৪ জানুয়ারি ছিল বাংলাদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের জন্মদিন। আজ থেকে ৬৮ বছর আগে ১৯৪৮ সালের এদিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে নাঈমউদ্দিন আহমেদকে আহ্বায়ক করে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে দেশের ঐতিহ্যবাহী এ ছাত্রসংগঠনটি জন্মলাভ করে। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে সংগঠনটির নাম ছিলো ‘ পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ’। স্বাধীনতার পর সংগঠনটির নাম পরিবর্তন করে ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’ করা হয়। দেশের ঐতিহ্যবাহী ও সংগ্রামী ছাত্র সংগঠন হিসেবে দেশের ইতিহাসের সাথে নিবিড়ভাবে এই ছাত্র সংগঠনের নাম জড়িয়ে আছে। এই ছাত্র সংগঠনের অনেক নেতা-কর্মী ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২’র শিক্ষা কমিশন আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান,এগারো দফা আন্দোলনসহ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় স্বাধিকার আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। বর্তমান জাতীয় রাজনীতির অনেক শীর্ষ নেতার রাজনীতিতে হাতেখড়িও এই ছাত্র সংগঠন থেকেই। জাতির জনকের হাতে গড়া ছাত্র সংগঠনটির অতীত অতি গৌরবের। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস!  সময়ের বিবর্তনে আর নীতিহীন রাজনীতির কবলে পড়ে ব্যক্তি স্বার্থের কাছে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের সময় অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী ঐতিহ্যবাহী এই ছাত্র সংগঠনটি এখন আর্দশ বিচ্যুত হয়ে সর্বদাই সমালোচিত ! বিগত সময়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী জুবায়ের আহমেদ হত্যা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দু’পক্ষের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে ছাত্রলীগের নেতা আবদুল্লাহ আল হাসান সোহেলের মৃত্যু,চট্টগ্রামে রেলের দরপত্র জমা দেয়া নিয়ে যুবলীগ-ছাত্রলীগের মধ্যে গোলাগুলিতে আট বছরের শিশু আরমান হোসেন ও যুবক সাজু পালিতের মৃত্যু, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের দু’পক্ষের মারামারিতে রাব্বী নামে এক শিশুর মৃত্যু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এ এফ রহমান হলের ছাত্রলীগের দু’পক্ষের সংঘর্ষের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের মেধাবী ছাত্র আবু বকরের মৃত্যু, ঐতিহ্যবাহী সিলেট এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে আগুন, দর্জি দোকানি বিশ্বজিত্ দাসকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করাসহ এমন অসংখ্য নিন্দনীয় ঘটনার জন্ম দিয়ে বারবার গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে দেশের ঐতিহ্যবাহী এই ছাত্র সংগঠনটি। রাজনীতির মাঠে বর্তমানে প্রতিপক্ষ নেই বললেই চলে। কিন্তু তারপরও কেন জানি এ ছাত্র সংগঠনের অনেক নেতা-কর্মীর মধ্যে বিন্দুমাত্র সহনশীলতা নেই। গণতন্ত্রের চর্চা নেই। বিগত সময়ে অভ্যন্তরীণ কলহের জের ধরে বহুবার এরা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। এসব সংঘর্ষে নিজ দলের নেতা-কর্মীসহ দেশের নিরপরাধ সাধারণ মানুষও রক্ষা পায়নি। এছাড়া সংগঠনটির বিভিন্ন নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে টেন্ডারবাজি, ধর্ষণ,অপহরণ, জমি দখল, চাঁদাবাজি, দরপত্র নিয়ন্ত্রণ, ভর্তিবাণিজ্য, ছিনতাই, রাহাজানি, খুন,গোলাগুলি যেন নিত্যদিনের সংবাদ ! গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে  (১১ আগস্ট ২০১৫) পর্যন্ত এই সাড়ে সাত বছরে ছাত্রলীগ নিজেদের মধ্যে বা অন্য সংগঠনের সঙ্গে কমপক্ষে ৫০০টি সংঘর্ষে জড়িয়েছে। এতে নিহত হয়েছে অন্তত ৫৮ জন। নিজ সংগঠনের ৩৯ জনের বাইরে বাকি ১৫ জনের মধ্যে দুটি শিশু এবং অন্যরা প্রতিপক্ষ সংগঠনের কর্মী বা সাধারণ মানুষ। এসব সংঘর্ষে আহত হয়েছে দুই হাজারের বেশি মানুষ। সামপ্রতিক সময়ে সাধারণ নিরীহ মানুষ, শিক্ষক, পুলিশ সাংবাদিক কেউ-ই এদের হাতে প্রহূত হওয়া থেকে বাদ পড়েনি ! এমনকি পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়স্থল মাতৃগর্ভও  এদের হামলা থেকে রক্ষা পায়নি ! ছাত্রলীগের বর্তমান কর্মকাণ্ডে শুধু দেশের জনগণ না, আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মীও বিরক্ত। বিগত  সময়ে বিভিন্ন নেতার বক্তব্যে এসব বিরক্তির কথা উঠেও এসেছে। কিন্তু তারপরও নেতা-কর্মীর অন্যায় কর্মকাণ্ড থেমে নেই। জাতির জনকের হাতে গড়া ঐতিহ্যবাহী এই ছাত্র সংগঠনটির কি করুণ দশা ! ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়  বাংলাদেশ এখন  ক্রমান্বয়ে উন্নতির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। অস্বীকার করার সুযোগ নেই অন্যান্য সময়ের তুলনায় দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এখন অনেক ভালো। বাংলাদেশ এখন নিম্ন মধ্যম-আয়ের দেশ। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হয়েছে। নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের রোল মডেল। কিন্তু বিগত সময়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগের বিভিন্ন নেতা-কর্মীর বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে সরকারের এসব সাফল্যের সংবাদ ম্লান করে দিচ্ছে। নতুন বছরে এ ছাত্র সংগঠনের কোন নেতা-কর্মী নিজেকে নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে জড়াবে না - এমনটাই প্রত্যাশা। দেশের শান্তিকামী মানুষ নতুন বছরে ঐতিহ্যবাহী এ ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীদের মাঝে সহনশীল আচরণ প্রত্যাশা করে।

এ দেশের মানুষ অস্ত্রের ঝনঝনানি দেখতে চায় না। পেশীশক্তির মহড়া দেখতে চায় না। দেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ের সেই ছাত্রলীগ দেখতে চায়। প্রিয় দেশ ও দেশের জনগণের কল্যাণে যারা সর্বদা নিবেদিত থাকবে। দেশের ঐতিহ্যবাহী এই ছাত্র সংগঠনের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারের জন্য, দেশের ভবিষ্যত্ রাজনীতির গুণগত মান বৃদ্ধি, শিক্ষাঙ্গনের সুষ্ঠু পরিবেশ রক্ষা এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে এর কোন বিকল্প নেই।

Sunday, 14 August 2016

আলাওল

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের বহুমুখী প্রতিভায় গুণান্বিত সৈয়দ আলাওল সাহিত্যজগতে এক নবযুগের সৃষ্টিকারী। কবি আলাওলের কাব্য সাধনা ছিল মূলত অনুবাদমূলক। কিন্তু একজন অনুবাদক হয়েও সৃষ্টিশীল লেখনী ও মৌলিকত্বের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে তিনি নতুন প্রাণের জন্ম দিয়েছেন। সতীময়না-লোরচন্দ্রানী, সপ্তপয়কর, সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামান, সেকন্দরনামা, নীতিকাব্য তোহফা প্রভৃতি রচনায় তাঁর সাহিত্য প্রতিভা স্ফুটিত হয়েছে। তিনি ফরাসি ভাষা হতে ‘সেকন্দরনামা’ ও ‘সপ্তপয়কর’ নামক দুটো কাব্য এবং ‘তোহফা’ ধর্মপুস্তকের অনুবাদ করেন। এসব অনুবাদ ব্যতীত কবি দৌলত কাজীর অসমাপ্ত ‘সতীময়না ও লোরচন্দ্রানী’ কাব্যের পরিসমাপ্তি করেন। ফরাসি পুস্তক অবলম্বনে ‘সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামাল’ নামক কাব্য রচনা করেন। বাংলা কাব্যকে তিনি অন্য প্রাদেশিক এবং মধ্যপ্রাচ্যের কাব্যধারার সঙ্গে সংযোজন করে এক নতুন মাত্রার সূত্রপাত করেছিলেন। মধ্যযুগের ধর্মসংস্কারমুক্ত মানবীয় প্রণয়কাহিনী অবলম্বনে কাব্য রচনা করে তিনি প্রথম ধর্মনিরপেক্ষ সাহিত্য রচনা শুরু করেন। একজন বাঙালি কবি হিসেবে তাঁর কাব্যে শুধু যে নারীর রূপ, বিরহ-বেদনা, প্রণয় প্রভৃতি প্রকাশ পেয়েছে তা নয়। মাতৃভূমির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনাও তাঁর কাব্যে খুঁজে পাওয়া যায়। মানুষের মনের স্বাভাবিক বিকাশ ও জাগতিক জীবনের উদার মহিমার ওপর ভিত্তি করে তিনি যেভাবে সাবলীল বর্ণনায় সাহিত্যের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছেন, সেকালে তার তুলনা তিনি নিজেই।
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের দেদীপ্যমান অত্যুজ্জ্বল নক্ষত্র মহাকবি আলাওলের জন্মস্থান ও জন্মকাল নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বিতর্কের উদ্ভব হলেও কবির স্বরচিত রচনায় এ বিতর্কের অনেকটাই অবসান হয়। কবির জীবনবৃত্তান্ত পদ্মাবতী ও সেকন্দরনামা হতে সংগ্রহ করা যায়।
মুল্লুক ফতেহাবাদ গৌড়তে প্রধান।
তথাতে জালালপুর অতিপূণ্য স্থান
বহু গুণবন্ত বৈসে খলিফা ওলেমা।
কথেক কহিব সেই দেশের মহিমা
মজলিস কুতুব তথাত অধিপতি।
মুই দীন হীন তান অমাত্য সন্ততি
কবির রচিত এ কাব্য অংশটুকু থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে মহাকবি আলাওল ফতেহাবাদ তথা বর্তমানে বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার লোক ছিলেন। আনুমানিক ১৬০৭ খ্রিস্টাব্দে এক অভিজাত মুসলিম পরিবারে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতা ছিলেন ফতেহাবাদের রাজ্যেশ্বর মজলিস কুতুবের একজন মন্ত্রী।
মহাকবির নাম ও নামের বানান নিয়েও পণ্ডিতদের মধ্যে মতবিরোধ লক্ষ করা যায়। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মনে করতেন আলাওলের প্রকৃত নাম ‘আলাউক হক’। ড. মুহম্মদ এনামুল হক মনে করেন তাঁর প্রকৃত নাম সৈয়দ আলাওল। আবার অনেক পণ্ডিত ‘শাহ’ যুক্তও ব্যবহার করেন। বর্তমানে ‘আলাওল’ নামই সর্বজনস্বীকৃত।
আলাওল সম্পর্কে যথার্থ তথ্য না থাকায় প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটন প্রায় অসম্ভব। তার পরও কবির রচিত গ্রন্থাবলি থেকে আগ্রহী সাহিত্যপ্রেমীদের নানাবিধ প্রশ্নের উত্তর মেলে। মহাকবি নিজের আত্মপরিচয় সম্পর্কে বলেছেন,
“রাজ্যেশ্বর মজলিস কুতুব মহাশয়।
আমি ক্ষুদ্রমতি তান অমাত্য তনয়
কার্যহেতু পন্থক্রমে আছে কর্ম লেখা।
দুষ্ট হারমাদ সঙ্গে হই গেল দেখা
বহু যুদ্ধ করিয়া শহীদ হৈল বাপ।
রণক্ষতে রোসাঙ্গে আইল মহাপাপ
আলাওলের পিতা ফতেহাবাদের রাজ্যেশ্বর মজলিস কুতুবের মন্ত্রী ছিলেন। একবার পিতার সঙ্গে নৌকাযোগে চট্টগ্রাম যাওয়ার সময় পর্তুগিজ জলদস্যুদের দ্বারা তাঁরা আক্রান্ত হন। এ সময়ে পর্তুগিজ জলদস্যুদের হাতে আলাওলের পিতা নিহত হন এবং তাদের সর্বস্ব লুণ্ঠিত হয়। আলাওল আহত হলেও প্রাণে বেঁচে যান। এরপর ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের শিকার হয়ে দীর্ঘপথ অতিক্রম করে আরাকানে (বার্মা) এসে উপস্থিত হন। জীবন ও জীবিকার তাগিদে এখানে তিনি একজন দেহরক্ষী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। শুরু হয় পরদেশে কবির নতুন জীবন-সংগ্রাম। এর কিছুদিনের ব্যবধানেই আলাওল মহন্তের গৃহে নাটগীত ও  সংগীত শিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেন। অল্প কিছু দিনের মধ্যে একজন সংগীতবিদ হিসেবে তাঁর খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এ খ্যাতির বদৌলতে সমাজের উচ্চ শ্রেণীর ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠার সুযোগ হয়। ক্রমেই আলাওলের উচ্চমার্গের কলাজ্ঞান, বিদ্যা-বুদ্ধির ও কবি প্রতিভার কথা অভিজাত সমাজে ছডিয়ে পড়তে থাকে। এ সুবাদে তিনি আরাকানের প্রধানমন্ত্রী বহুশাস্ত্রবিদ কবি কোরেশী মাগন ঠাকুরের কাছে আশ্রয় লাভের সুযোগ পান। তত্কালীন সময়ে আরাকান রাজসভায় চমত্কার এক সাহিত্যিক পরিবেশ বিরাজ করছিল। মূলত কোরেশী মাগন ঠাকুর কাছে আশ্রয় লাভের সময় থেকেই আলাওল কাব্য সাধনায় নিজেকে সম্পূর্ণরূপে আত্মনিয়োগ করেন। এ সময় একের পর এক তাঁর কবি প্রতিভার স্ফুটন ঘটতে থাকে এবং সাধারণ আলাওল থেকে তিনি হয়ে ওঠেন আজকের মহাকবি আলাওল।
আলাওল মধ্যযুগের সর্বাধিক গ্রন্থপ্রণেতা বাঙালি মুসলিম কবি। তাঁর মোট কাব্য সংখ্যা সাত। বাংলা সাহিত্যের মৌলিকত্ব, কাহিনী রূপায়ণ, চরিত্র নির্মাণ এবং প্রকাশভঙ্গির ক্ষেত্রে তিনি এক বৈচিত্র্যপূর্ণ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। ‘সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামাল’ প্রেমমূলক কাহিনী কাব্য। এ কাব্যে রাজপুত্র সয়ফুলমুুলুক ও পরীরাজ কন্যা বদিউজ্জামালের মধ্যকার প্রণয় বৃত্তান্ত বর্ণিত হয়েছে। সতীময়না-লোরচন্দ্রানী দৌলত কাজীর অসমাপ্ত কাব্য আমত্য সুলায়মানের অনুরোধে ১৬৫৯ সালে তিনি এটা সমাপ্ত করেন। এ কাব্যে রানী ময়নামতী, রাজা লোর ও রাজকন্যা চন্দ্রানীর প্রেমবৃত্তান্ত সুন্দর ও সাবলীলভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। পারস্যরাজ বাহরাম ও তাঁর সাত রানীর গল্প কবির রচিত সপ্তপয়কর গ্রন্থের বর্ণনীয় বিষয়। নীতিবাক্য তোহফা কাব্যে কবি নিজের বার্ধক্যের কথা বলে আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন। গ্রিকরাজ সেকন্দর বা আলেকজান্ডারের এবং পারস্যরাজ দারাউসের যুদ্ধের বৃত্তান্ত এবং সেকান্দরের দিগ্বিজয় বর্ণিত আছে কবির রচিত সেকন্দরনামা নামক সর্বশেষ গ্রন্থে। এ কাব্যে সুফিভাবের কবিতাও দেখা যায়:
‘আইস গুরু প্রেম সুরা দেও মোরে ভরি।/যার পানে মিত্র লাভ আপনা পসারি’
তবে পদ্মাবতী কাব্যটি সৈয়দ আলাওলের সর্বপ্রণিধান্য সাহিত্যকর্ম। ১৬৪৮ খ্রিস্টাব্দে আরাকান প্রধানমন্ত্রী মাগন ঠাকুরের অনুরোধে মালিক মুহাম্মদ জায়সীর হিন্দি পদুসাবত হতে প্রায় তিন বছর ধরে তিনি এর অনুবাদ করেন। পদ্মাবতী দুটি পর্বে বিভক্ত। প্রথম পর্বে সিংহলের রাজকন্যা পদ্মাবতীকে লাভ করার জন্য চিতোররাজ রত্নসেনের সফল অভিযান এবং দ্বিতীয? পর্বে রাণী পদ্মাবতীকে লাভ করার জন্য দিল্লির সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির ব্যর্থ সামরিক অভিযানের বিবরণ আছে। অনুবাদধর্মী হলেও পদ্মাবতীর ভাষা, নাগরিক রুচি-শিক্ষা, সংস্কৃতি, মানবিকতা অনন্যসাধারণ হয়ে ফুটে উঠেছে সর্বত্র। ফলে সাহিত্যপ্রেমীদের কাছে মৌলিকতার মর্যাদায় আজো সমাসীন। মূলত এই শিল্পকর্মের ভাষাজ্ঞান ও পাণ্ডিত্য সৈয়দ আলাওলকে মহাকবির মর্যাদায় আসীন করে।
মধ্যযুগের বাঙালি কবিদের মধ্যে আলাওলের স্থান অতি ঊর্ধ্বে। আরবি, ফারসি, সংস্কৃত, ব্রজবুলি ও হিন্দি ভাষাতে তিনি পারদর্শী ছিলেন। তাঁর রচনা থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় তিনি যোগশাস্ত্র, সংগীতবিদ্যা প্রভৃতি বিষয়েও অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। পাঠকের উদ্দেশে তাঁর রচিত একটা সংস্কৃত শ্লোক এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে।
‘মূর্খানাং প্রতিমা দেবো বিপ্রদেবো হুতাশনঃ।/যোগীনাং প্রার্থনা দেবো দেবদেবো নিরঞ্জন
কবি স্বয়ং এর অনুবাদ করেছেন—
‘মূর্খ সকলের দেব প্রতিমা সে সার,/ব্রাহ্মণ সবের দেব অগ্নি অবতার।/যোগী সকলের দেব আপ্ত মহাজন/সকল দেবের দেব প্রভু নিরঞ্জন’
মহাকবি আলাওল ছিলেন ভাগ্যবিড়ম্বিত এক কবি। সারা জীবন নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে কেটেছে। রাজপরিবারের সন্তান হয়েও নিরবিচ্ছন্ন সুখের সাগরে নিজেকে ভাসিয়ে রাখতে পারেননি। ছোটবেলা পিতাকে হারিয়ে অনিশ্চিত জীবনের যে যাত্রা শুরু করেছিলেন, বলতে গেলে জীবনের শেষ অবধি তা অব্যাহত ছিল। ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে কারারুদ্ধ হয়েছেন। নানা বিদ্যায় বিশারদ মহাকবি আলাওল জীবনের পড়ন্তবেলা আধ্যাত্মিক মার্গতায় চলে গিয়েছিলেন। আলাওলের কাব্যে আত্মপরিচয়ে শেষ জীবনে ভিক্ষা করে বাঁচার ঘটনা আমাদের ব্যথিত করে।

Saturday, 13 August 2016

বন্যায় আক্রান্ত জনপদ

ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশ প্রায় প্রতি বছরই বন্যাকবলিত হয়। এবারো এর ব্যতিক্রম হয়নি। অতিবৃষ্টির ফলে নদীর পানি উপচে লোকালয়ে প্রবেশ করে বন্যার সৃষ্টি করে। তবে অনেকের মতে, এবারের সৃষ্ট বন্যার কারণ ভিন্ন। ভারতের উজানের পানি ও পাহাড়ি ঢল এবারের বন্যার জন্য দায়ী। কারণ যা-ই হোক না কেন, দেশের বিভিন্ন জেলা বন্যাকবলিত হয়ে অসংখ্য মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এরই মধ্যে। বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে আরো নতুন জেলা কবলিত হবে। বন্যায় বিশেষ করে দেশের উপকূলীয় ও নিম্নাঞ্চল বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়া ও সিরাজগঞ্জ জেলাগুলোর নিম্নাঞ্চল এবং গঙ্গা-পদ্মা নদীসংলগ্ন রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ ও শরীয়তপুর জেলাগুলোর বেশকিছু নিম্নাঞ্চল এখন বন্যাকবলিত। নদী-নালা, খাল-বিল প্লাবিত হয়ে বন্যার পানি উপচে পড়ছে সমতল ভূমিতে। রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, স্কুল-কলেজ সবই অথৈ জলে ভাসছে। দেশের লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। বন্যার কারণে এরই মধ্যে অসংখ্য পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়েছে। নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে অনেকের বসতবাড়ি। কৃষকের ফসলি জমি নষ্ট হয়েছে। বানের জলে ভাসছে সাধারণ মানুষের নিয়তি। এসব বানভাসি মানুষের মানবেতর জীবনের গল্প গণমাধ্যমে সচিত্র প্রতিবেদনসহ প্রকাশিত হচ্ছে। এসব দুর্গত মানুষের দুর্ভোগের কথা লিখে বোঝানো যায় না। হূদয় দিয়ে অনুভব করতে হয়।
নামমাত্র যে ত্রাণসামগ্রী দেয়া হচ্ছে, তাও বন্যার্তদের অনেকেই পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ। বানভাসি একজন মানুষও যেন খাদ্যাভাবে, সাহায্যের অভাবে, চিকিত্সার অভাবে যেন মারা না যায়— সেদিকে আমাদের লক্ষ্য রাখা উচিত। বন্যার্ত মানুষের জন্য পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী ও চিকিত্সার ব্যবস্থা করা মানবিক দায়িত্ব। তাদের প্রতি সবার সদয় হতে হবে। এখন বন্যা পরিস্থিতির অনেকটাই উন্নতি হয়েছে। কিন্তু দেখা দিয়েছে নতুন সমস্যা। এসব অঞ্চলের অনেকেই পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের অভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন অনেকে। দুর্ভোগের পাশাপাশি অর্থনৈতিক ক্ষতি তো আছেই। ঘরবাড়ি, গৃহপালিত পশু, ফসলি জমি, মাছের ঘের, বীজতলা প্রভৃতি নষ্ট হয়েছে। ফলে বন্যায় বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।
বাংলাদেশে বন্যা একটি স্বাভাবিক ঘটনা। এ সমস্যা সমাধানে তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ চোখে পড়ে না। বন্যার ক্ষতি ও প্রতিকূল প্রভাব হ্রাস করতে এবং অতিরিক্ত পানি সেচকার্যে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কিছু বাঁধ নির্মাণ ও খাল খনন করেছে। কিন্তু সেগুলো যে পর্যাপ্ত নয়, তা বন্যাক্রান্ত হলেই বোঝা যায়। এছাড়া বন্যা নিয়ন্ত্রণে শুধু কাঠামোগত উন্নয়ন হলেই হবে না, অবকাঠামোগত নানা উন্নয়নও অপরিহার্য।
বন্যা একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলেও সম্মিলিতভাবে তা মোকাবেলা করা অসম্ভব নয়। বন্যাকবলিত মানুষের সাহায্যার্থে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও সমাজের বিত্তশালী মানুষের এগিয়ে আসতে হবে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী ও চিকিত্সা সরবরাহ করতে হবে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের ব্যাংকঋণ মওকুফের পাশাপাশি চাষাবাদের জন্য প্রয়োজনীয় কৃষিপণ্য বিনামূল্যে সরবরাহ করতে হবে। রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রভৃতি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নির্মাণ করতে হবে।


Tuesday, 2 August 2016

ভেজাল ওষুধ, নাকাল ভোক্তা

ওষুধ যদি ভেজাল ও নিম্নমানের হয়, তাহলে পাঠক ভাবুন তো কী ভয়ঙ্কর অবস্থা হতে পারে? ভাবলেই ভয়ে গা শিউরে ওঠে। দেশে এখন সবকিছুতেই ভেজাল। বলতে গেলে এ যেন এক ভেজালের রাজত্বে আমাদের বসবাস! মানুষের নীতি-নৈতিকতার স্খলন হচ্ছে। নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য বৃহত্ অন্যায় কাজ করতেও মানুষ এখন পিছপা হচ্ছে না। অসাধু ব্যবসায়ী শুধু ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘন করছে না, জনস্বাস্থ্য হুমকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। দেশের প্রতিষ্ঠিত নামি-দামি কোম্পানির ওষুধ ব্যাপক হারে নকল হচ্ছে; বিশেষ করে যে ওষুধগুলোর বাজারে কাটতি বেশি। অধিক মুনাফার লোভে একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী এসব ওষুধ নকল করেন। নকল ওষুধের মোড়ক ও আসল ওষুধের মোড়ক দেখতেও প্রায় একই রকম। শিক্ষিত মানুষের পক্ষে দুইয়ের পার্থক্য খুঁজে বের করে আসলটা কেনা বেশ কষ্টসাধ্য। শিক্ষাহীন মানুষের পক্ষে তো একেবারেই অসম্ভব। সবচেয়ে বড় বিষয়, দেশের অধিকাংশ মানুষের ওষুধ সম্পর্কে জ্ঞান বলতে গেলে একদম শূন্যের কোটায়। অসাধু ব্যবসায়ী শ্রেণী এ সুযোগেরই সুবিধা নিচ্ছে। আর আমজনতা নকল ও ভেজাল ওষুধ কিনে প্রতারিত হচ্ছে। শহরের তুলনায় গ্রাম ও মফস্বল শহরে নকল ও ভেজাল ওষুধ বেশি বিক্রি হয়। গ্রামের সহজ-সরল, অর্ধশিক্ষিত ও অশিক্ষিত মানুষের সরলতার সুযোগ নিয়ে ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ কোম্পানিগুলো তাদের ব্যবসার ক্ষেত্রকে গ্রাম ও মফস্বল শহরে সম্প্রসারণ করছে। কিছু গ্রাম্য হাতুড়ে ডাক্তার তাদের এ জনস্বার্থবিরোধী কাজ বিস্তারে সহযোগিতা করছেন। কোম্পানির কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের আর্থিক সুবিধাপ্রাপ্তির বিনিময়ে তারা ওইসব কোম্পানির নিম্নমানের ওষুধ রোগীদের প্রেসক্রাইব করেন। রোগী নিরুপায় হয়ে ওইসব ওষুধ সেবন করতে বাধ্য হন।
সম্প্রতি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ১৯৭৬ সালের জিএমপি (গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিস) নীতিমালা অনুসরণ করে মানসম্পন্ন উপায়ে ওষুধ প্রস্তুত না করাসহ আরো বেশকিছু কারণে দেশের ২০টি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিলসহ ৫৪টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন রকম শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছে। এখন এ সুপারিশ কতটুকু বাস্তবে কার্যকর হয়, তা দেখার অপেক্ষা। ওষুধ কারখানার উত্পাদিত ওষুধের মান নিয়ে আমরা বিভিন্ন সময় পত্র-পত্রিকায় অনুসন্ধানী প্রতিবেদন দেখি। সেখানে ওষুধ শিল্পের নৈরাজ্য নিয়ে ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরা হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, মিডিয়ায় বিভিন্ন অভিযোগ তুলে ধরে প্রতিবেদন প্রকাশ হলেও কর্তৃপক্ষ তেমন কার্যকর ব্যবস্থা নেয় না। অনেক সময় দেখা যায়, প্রশাসনের নাকের ডগায় বিক্রি হয় ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ। খোদ রাজধানীর ফুটপাত দিয়ে চলার সময় বিভিন্ন মোড়ে ভেষজ ওষুধের নামে বিভিন্ন ধরনের ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ বিক্রি চোখে পড়ে। এসব ওষুধপত্র উপকারে তো আসেই না, বরং জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। মাঝে মধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়। তবে তা যথেষ্ট নয়। এছাড়া বেশির ভাগ সময় অভিযানগুলো পরিচালিত হয় ওষুধের দোকানগুলোয়। কিন্তু আদৌ এর কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। কারণ ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ তো দোকানদার উত্পাদন করে না, উত্পাদন করে কোনো না কোনো অবৈধ ওষুধ কোম্পানি। তাই ভেজাল ওষুধ রোধে সবার আগে ভেজাল ওষুধ উত্পাদনকারী প্রতিষ্ঠান চিরতরে বন্ধ করতে হবে। এছাড়া অভিযানগুলো সীমিত পরিসরে পরিচালিত না করে গ্রাম ও মফস্বল শহরেও ছড়িয়ে দিতে হবে। গ্রাম্য ডাক্তারদের বিষয়েও সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা দরকার, যাতে মানুষের জীবন নিয়ে তারা ছেলেখেলা করতে না পারে।

এ শিক্ষা আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?

সাত সকালে পূর্বাকাশে সূর্যিমামা উঁকি দেয়ার অনেক আগেই মহানগরীর কর্মব্যস্ততা শুরু হয়ে যায়। বৈদ্যুতিক তারের উপর বসে থাকা কাকগুলো প্রথমবার কা’ করে ওঠার আগেই শশব্যস্ত মায়েরা বইপত্রের পসরা সাজিয়ে বের হয়ে পড়েন সন্তানকে নিয়ে। লক্ষ্য ঘুম ঢুলুঢুলু চোখে ঝিমুতে থাকা সন্তানটিকে সময়মত স্কুলে রেখে আসা। ব্যস্ত নগরীর এটা প্রতিদিনের রুটিন। এছাড়া সন্তানকে স্কুল-কলেজে ভর্তি করানো তো আছে, সঙ্গে যুক্ত হয় প্রাইভেট কিংবা কোচিং-এর বাড়তি চাপ। যদি প্রশ্ন করা হয় মায়েরা এমন অমানবিক ক্লান্তহীন পরিশ্রম কেন করছেন, বাবারা তাদের রক্ত জল করা শ্রমে আয়করা অর্থ কিসের পেছনে ব্যয় করছেন? সব প্রশ্নের সহজ উত্তর সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যত্ নিশ্চিত করা। কিন্তু পরক্ষণেই যদি প্রশ্ন করা যায় এ ভবিষ্যত্ কি শুধুই পরীক্ষার ভালো ফল অর্জনের ওপর নির্ভরশীল? তখন অনেকই নীরব হয়ে যেতে বাধ্য। তারপর কেউ কেউ মুখ ফসকে বলেও দিতে পারেন এটা আমার ছেলে-মেয়ের এ প্লাস পাওয়ার জন্য। কেউ যদি প্রশ্ন করেন এ প্লাস পেলে কী হবে? যদি এ প্লাস না পায় তবে কী হবে? এক্ষেত্রে মা-বাবার ঢালাও বিশ্বাস এ প্লাস প্রাপ্তি সোনালী ভবিষ্যতের হাতছানি, আর এ প্লাস প্রাপ্তির ব্যর্থতা মূর্তিমান এক ধ্বংসস্তূপের হাতছানি। বাস্তবে সন্তানদের এমন অসহনীয় পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় যাচাইয়ের মূল মানদণ্ড ভালো ফলাফল হয়ে যাওয়াতে। এখানে প্রতিটি শিক্ষার্থীর জীবন কোনো কল-কারখানার যন্ত্রাংশ থেকে ভিন্ন কিছু নয়। সবাই এখানে দৌড়াচ্ছে ভালো ফলের পেছনে, ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত শিশুরা ভয়ে কেউ কেউ জীবন থেকে ছুটি নিয়ে ফেলছে বিরক্তি ভরে। তারপরও মা-বাবার প্রত্যাশার কমতি নেই। সমাজ তাদের কী দায়িত্ব দিয়েছে, মানুষ হতে গেলে কী করতে হবে পাশাপাশি আরো নানা বিষয় নিয়ে তাদের চিন্তার সুযোগ কোথায়? তাদের দৌড় এক ভালো ফলাফলের পেছনে আর এটা করতে গেলে পেতে হবে অনেক নম্বর। প্রয়োজনে গোপনে বের করে আনতে হবে প্রশ্নপত্র। তারপর মুখস্থ করে, অন্যেরটা দেখে উত্তরপত্রে ঢেলে দিলেই কেল্লা ফতে। নীতি-নৈতিকতার এখানে কোনো স্থান নেই। আর এভাবে চলতে গিয়ে বাস্তবে এক খাদের কিনারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা।
বেশ কিছুদিন আগে দেশের ‘শিক্ষা ব্যবস্থার মান’ নিয়ে প্রশ্ন তুলে একটি বেসরকারি টেলিভিশনে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটি প্রকাশের পরই এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুরু হয় তর্ক-বির্তক। প্রতিবেদক জিপিএ-৫ পাওয়া ১৩ জন শিক্ষার্থীকে কিছু প্রশ্ন করার মাধ্যমে বর্তমান শিক্ষার ব্যবস্থার সার্বিক চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। প্রতিবেদক এবং প্রতিবেদনটি নিয়ে তর্ক-বির্তক থাকলেও মনে করি প্রতিবেদনে ফুটে উঠা শিক্ষার করুণ দশা সম্পর্কে সচেতন মহলে বির্তক নেই। জিপিএ এবং এসএসসি-এর পূর্ণাঙ্গ রূপ কী, শহীদ মিনার ও স্মৃতিসৌধের অবস্থান কোথায়, অপারেশন সার্চ লাইট কী, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস কবে, স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবস কবে, মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশকে কয়টি সেক্টরে ভাগ করা হয়েছিল— প্রতিবেদকের এমন অতি সাধারণ প্রশ্নে জিপিএ-৫ পাওয়া ১৩ জন শিক্ষার্থী যে উত্তর দিয়েছেন তা খুবই হতাশাজনক। যদিও  লক্ষাধিক শিক্ষার্থীর অর্জন মাত্র ১৩ জন শিক্ষার্থী দিয়ে বিচার করা যায় না। তবে ঐ ১৩ জন যে উত্তর দিয়েছে তা আর কিছু নয়, জাতির হতাশার প্রহর দীর্ঘায়িত হওয়ার স্পষ্ট ইঙ্গিত বটে।
শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশ ও সৃজনশীল হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে সরকার ২০০৮ সালে উন্নত বিশ্বের প্রশ্নপত্রের ধারণায় সনাতন প্রশ্ন পদ্ধতি বাদ দিয়ে দেশে শিক্ষা ব্যবস্থায় সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি চালু করে। প্রথম বছর পরীক্ষামূলকভাবে সাধারণ শিক্ষায় এসএসসি পর্যায়ে এটা চালু করা হয়। পরে তা মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষায়ও প্রয়োগ করা হয়। এছাড়াও শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশের জন্য সরকার আইন করে প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তকের নোট বই মুদ্রণ, বাঁধাই, প্রকাশনা, আমদানি, বিতরণ ও বিক্রি নিষিদ্ধ করে। উচ্চ আদালতের এক রায়ে গাইড ও নোট বই মুদ্রণ ও বাজারজাত সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়। গৃহীত এ সকল পদক্ষেপ যুগোপযোগী এবং প্রশংসনীয়ও বটে। তবে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে— নোট বা গাইড বই মুদ্রণ ও বাজারজাত নিষিদ্ধ করা হলেও বইয়ের দোকানগুলোতে অনেকটা প্রকাশ্যেই নোট বা গাইড বই বিক্রি করা হয়।
তাছাড়া পরীক্ষায় নোট বা গাইড থেকে প্রশ্ন করা হলে শিক্ষার্থীরা পাঠ্য বইয়ের উপর আগ্রহ হারিয়ে নোট বা গাইডের উপর নির্ভরশীল হবে। জাতির জন্য যা হবে অপূরণীয় ক্ষতি। শিক্ষার্থীদের মেধার বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে, বিফলে যাবে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য। জাতির বৃহত্তর স্বার্থে জাতির মেরুদণ্ড শিক্ষাখাত নিয়ে কোনোভাবেই ছেলেখেলা করা যাবে না।

Saturday, 14 May 2016

পরিণাম

পূর্ণিমার চাঁদ ডুবে গেছে
তোমার বিদায়ের ক্ষণে
চারদিক ঘোর অন্ধকার
সোনালি দিনের প্রতীক্ষায়
কেটে যাচ্ছে অগণিত রজনি
মহাকালের গলগ্রহ হয়ে আমি
স্মৃতি আঁকড়ে ভাবোদ্দীপক হই
প্রতিটি ক্ষণে-ক্ষণে মৃত্যু হয় আমার

নিয়তি

বিষন্নতার মাঝে জেগে উঠা
জ্যোৎসালোকিত চাঁদ
তেজস্বী সূর্যের আলো
স্বধর্মদ্বেষী হয়ে নিজস্বতা হারায়
অদৃষ্টের এমন নির্মমতায় আশাহত হয় সর্বশুভবাদী যুবক
হারিয়ে যেতে চায় বহুদূরবর্তী স্থানে
যেখানে নেই কোন হতাশা
নেই কোন অপ্রাপ্তির যন্ত্রনা
অদৃশ্যমান শিকলের বেড়ি
মহাযাত্রার পথ গতিরোধ করে
উত্তাল সমুদ্রের বুকে ডিঙ্গি নৌকায়
দোদুল্যমান শুভদর্শী যুবকের নিয়তি

অনুভূতি

দীর্ঘদিন পর তাঁর সাথে কথা হলো
আত্মার সম্পর্ক ;
একদিন কথা না হলে, দেখা না হলে
মনে হয় যেন - একযুগ কথা হয়নি, দেখা হয়নি
শূন্যতা অনুভূত হয়
এমন শূন্যতার নামই
বোধহয় - ভালোবাসা, প্রেম

আমি প্রেমে পড়েছি

আমি প্রেমে পড়েছি 
গভীর অন্ধকারে জ্বলে থাকা একটি ছোট্ট প্রদীপের
যার আলোর শিকায় জ্বলজ্বল করে প্রেয়সীর মুখ
আমি প্রেমে পড়েছি
নীল সমুদ্রের বুকে জেগে উঠা উত্তাল ঢেউয়ের
প্রেয়সীর কলঙ্ক মোচনের জন্য তীব্র বেগে যে তীরে ছুটে আসে
প্রেয়সীর কলঙ্ক মুছে সতীসাধ্বী করে
আমি প্রেমে পড়েছি
সমুদ্রতটে পড়ে থাকা শঙ্খ-ঝিনুকের
প্রিয়ার কানের দুল, হাতের চুড়ি কিংবা গলার মালা হয়ে যে অমরত্ব লাভ করে
আমি প্রেমে পড়েছি
ফাল্গুনি বাতাসে ঝরে পড়া মরা পাতার
প্রেয়সীর নরম পায়ের স্পর্শের জন্য যে গালিচা হয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনে
আমি প্রেমে পড়েছি
বসন্তের কোকিলের
যার কুহূ কুহূ ডাকে প্রেয়সীর হৃদয়ে শূন্যতার ঝড় তোলে
আমি প্রেমে পড়েছি
ঝরে পড়া শিউলির, ছোট্ট বকুলের
প্রিয়ার চুলের খোঁপা হয়ে যে সুঘ্রাণ ছড়ায়
আমি প্রেমে পড়েছি
ভোরের গানের পাখির
যাদের কিচিরমিচির ডাকে প্রেয়সী নতুন সূর্যের আহবানে সাড়া দেয়
আমি প্রেমে পড়েছি
গভীর অরণ্যে খড়ের তৈরি এক ছোট্ট কুঠিরের
প্রত্যহ সন্ধায় প্রেয়সীর হাতে যেখানে সন্ধা প্রদীপ জ্বলে

বন্দনা

তুমি রবে সন্দীপনে
নিভৃতে হৃদয় মাঝে
অনন্তকাল
মানুষ না, দেবী হয়ে
প্রভাতের রক্তিম সূর্য প্রত্যহ প্রণাম জানাবে
রক্ত জবা ফুটে থাকবে তোমার পদস্পর্শের অপেক্ষায়
সধবা' হাতের সিঁদুরে রাঙা হবে তোমার ললাট
আশাহত প্রেমিকের দল নতমস্তকে মাল্যদান করে
উচ্চস্বরে গাইবে তোমার স্তুতিগান
বর হিসেবে চাইবে - পরজন্মে যেন তুমি প্রেয়সী হও