ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশ প্রায় প্রতি বছরই বন্যাকবলিত হয়। এবারো এর ব্যতিক্রম হয়নি। অতিবৃষ্টির ফলে নদীর পানি উপচে লোকালয়ে প্রবেশ করে বন্যার সৃষ্টি করে। তবে অনেকের মতে, এবারের সৃষ্ট বন্যার কারণ ভিন্ন। ভারতের উজানের পানি ও পাহাড়ি ঢল এবারের বন্যার জন্য দায়ী। কারণ যা-ই হোক না কেন, দেশের বিভিন্ন জেলা বন্যাকবলিত হয়ে অসংখ্য মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এরই মধ্যে। বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে আরো নতুন জেলা কবলিত হবে। বন্যায় বিশেষ করে দেশের উপকূলীয় ও নিম্নাঞ্চল বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়া ও সিরাজগঞ্জ জেলাগুলোর নিম্নাঞ্চল এবং গঙ্গা-পদ্মা নদীসংলগ্ন রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ ও শরীয়তপুর জেলাগুলোর বেশকিছু নিম্নাঞ্চল এখন বন্যাকবলিত। নদী-নালা, খাল-বিল প্লাবিত হয়ে বন্যার পানি উপচে পড়ছে সমতল ভূমিতে। রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, স্কুল-কলেজ সবই অথৈ জলে ভাসছে। দেশের লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। বন্যার কারণে এরই মধ্যে অসংখ্য পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়েছে। নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে অনেকের বসতবাড়ি। কৃষকের ফসলি জমি নষ্ট হয়েছে। বানের জলে ভাসছে সাধারণ মানুষের নিয়তি। এসব বানভাসি মানুষের মানবেতর জীবনের গল্প গণমাধ্যমে সচিত্র প্রতিবেদনসহ প্রকাশিত হচ্ছে। এসব দুর্গত মানুষের দুর্ভোগের কথা লিখে বোঝানো যায় না। হূদয় দিয়ে অনুভব করতে হয়।
নামমাত্র যে ত্রাণসামগ্রী দেয়া হচ্ছে, তাও বন্যার্তদের অনেকেই পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ। বানভাসি একজন মানুষও যেন খাদ্যাভাবে, সাহায্যের অভাবে, চিকিত্সার অভাবে যেন মারা না যায়— সেদিকে আমাদের লক্ষ্য রাখা উচিত। বন্যার্ত মানুষের জন্য পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী ও চিকিত্সার ব্যবস্থা করা মানবিক দায়িত্ব। তাদের প্রতি সবার সদয় হতে হবে। এখন বন্যা পরিস্থিতির অনেকটাই উন্নতি হয়েছে। কিন্তু দেখা দিয়েছে নতুন সমস্যা। এসব অঞ্চলের অনেকেই পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের অভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন অনেকে। দুর্ভোগের পাশাপাশি অর্থনৈতিক ক্ষতি তো আছেই। ঘরবাড়ি, গৃহপালিত পশু, ফসলি জমি, মাছের ঘের, বীজতলা প্রভৃতি নষ্ট হয়েছে। ফলে বন্যায় বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।
বাংলাদেশে বন্যা একটি স্বাভাবিক ঘটনা। এ সমস্যা সমাধানে তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ চোখে পড়ে না। বন্যার ক্ষতি ও প্রতিকূল প্রভাব হ্রাস করতে এবং অতিরিক্ত পানি সেচকার্যে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কিছু বাঁধ নির্মাণ ও খাল খনন করেছে। কিন্তু সেগুলো যে পর্যাপ্ত নয়, তা বন্যাক্রান্ত হলেই বোঝা যায়। এছাড়া বন্যা নিয়ন্ত্রণে শুধু কাঠামোগত উন্নয়ন হলেই হবে না, অবকাঠামোগত নানা উন্নয়নও অপরিহার্য।
বন্যা একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলেও সম্মিলিতভাবে তা মোকাবেলা করা অসম্ভব নয়। বন্যাকবলিত মানুষের সাহায্যার্থে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও সমাজের বিত্তশালী মানুষের এগিয়ে আসতে হবে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী ও চিকিত্সা সরবরাহ করতে হবে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের ব্যাংকঋণ মওকুফের পাশাপাশি চাষাবাদের জন্য প্রয়োজনীয় কৃষিপণ্য বিনামূল্যে সরবরাহ করতে হবে। রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রভৃতি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নির্মাণ করতে হবে।
No comments:
Post a Comment