একটু লক্ষ্য করে দেখেন, আমাদের জীবনযাত্রার সাথে- সাথে পাল্টে যাচ্ছে পুরো পৃথিবীটা। দীর্ঘমেয়াদী লক ডাউনে এক প্রকার স্থবির হয়ে পড়েছে জনজীবন। যান্ত্রিক নগরীতে মানুষের কোলাহল কমেছে। দীর্ঘ যানজটের দেখা নেই কয়েকমাস, যানবাহনের বিষাক্ত কালো ধোঁয়া কমেছে বহুগুণে। কয়েকমাস কল- কারখানাগুলো বন্ধ থাকায় বায়ু দূষণ কমেছে। গাড়ির অপ্রয়োজনীয় হর্ণের অসহ্য প্যাপু শব্দের সাথে সাথে থেমে গেছে রিক্সার ক্রিং ক্রিং কর্কট শব্দ। যে নগরীর দিন শুরু হতো ছুটে চলার মধ্যদিয়ে, এখন অলস সময় পার করছে। পাল্টে গেছে নগরের, নগরীর মানুষের চিরচেনা রূপ। এ পরিবর্তন যেন অনেকটা স্বপ্নের মতো!
চারদিকে এখন শুধু সবুজের সমাহার, প্রকৃতি সেঁজেছে তাঁর আপন সাঁজে। সমুদ্রে ডলফিনকে খেলা করতে দেখা যাচ্ছে, সুন্দরবন এলাকায় রাস্তায় হরিণ বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেন্টমার্টিনে কচ্ছপ সমুদ্রকূলে ডিমে পেড়ে নিরভিগ্নে আবার সমুদ্রে ফিরে যাচ্ছে, কুয়াকাটায় লাল কাঁকড়ার আলপনা আকার দৃশ্য, গাছে- গাছে নানা রঙের ফুল, চারদিক মুখরিত পাখির কিচিরমিচির ডাকে, নদীগুলো ক্রমশ হারানো যৌবন ফিরে পাচ্ছে, নগরীর কোলাহলের পরিবর্তে চারপাশে সুনসান নিরবতা। করোনাকালে নিরুদ্বিগ্ন প্রকৃতি দিনেদিনে ফিরে পাচ্ছে তাঁর হারানো সৌন্দর্য। চারপাশে চোখ ধাঁধানো নৈসর্গিকতা।
একটু গভীরভাবে চিন্তা করে দেখুন, এই আমরা, মানবজাতি প্রকৃতির উপর কী অত্যাচারটাই না এতদিন করছি! সবারই সহ্য, ধৈর্যেরও তো একটা সীমা থাকে। আমাদের প্রাত্যহিক অত্যাচার ও নির্মমতা প্রকৃতিকে দিনেদিনে ক্ষেপিয়ে তুলেছে। বাস্তুতন্ত্র ভেঙে পড়েছে। কে জানে প্রকৃতির এই ভারসাম্যহীনতার জন্যই হয়ত করোনার মতো ভয়ংকর ভাইরাসের সৃষ্টি। অদৃশ্য এক শক্তি যা গোটা বিশ্বের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে। প্রকৃতির কী বিচার, চায়না, যুক্তরাষ্ট্র ও ইংল্যান্ডসহ যেসকল দেশের কারণে জলবায়ু সবচেয়ে বেশি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেসব দেশই এখন সবচেয়ে বেশি করোনার শিকার। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান, প্রযুক্তি কোন কিছু করোনার বিস্তার ঠেকাতে পারছে না। এটা মানবজাতির জন্য প্রকৃতির এক সর্তক বার্তা।
মানুষ ভুলে গিয়েছিল স্রষ্টার সৃষ্টি সুন্দর এই গ্রহটার উপর তাদের পাশাপাশি অন্যান্য প্রাণীদেরও অধিকার আছে। আজ অত্যাচারীদের দল ঘরে বসে হা-হুতাশ করছে। অন্যদিকে নির্যাতিত শ্রেণী বাইরে আনন্দ উল্লাস করছে। মানুষ ভেবেছিল এই পৃথিবীর সবকিছু যাচ্ছেতাই ভাবে তাদের ভোগের অধিকার আছে। কিন্তু আসলে যে তা নেই এখন ভালোভাবে বুঝতে পারছে। প্রকৃতিতে ভারসাম্য বজায় রেখে যে সবকিছু ভোগ করতে হয়, ভোগের সময় মানুষ এই কথাটা মনে রাখে না। ইচ্ছে হলেই মানুষ বৃক্ষ নিধন করে, করকারখানার নোংরা দূষিত ময়লা নদীতে ফেলে জল দূষণ করে, নদী দখলে নিয়ে ভরাট করে শিল্প- কারখানা গড়ে তোলে, যেখানে সেখানে প্লাস্টিক ময়লা আর্বজনা ফেলে মাটি দূষণ করে, ইচ্ছে হলেই বিরল প্রজাতির কোন প্রাণী ধ্বংস করে, জবাই করে খেয়ে ফেলে, গাড়ির হর্ণ চেপে বসে থাকে, ইটভাটায় গাছ কেটে ইট পোড়ায়, বনাঞ্চলে আগুন ধরিয়ে দেয়, মানগ্রোভ বনাঞ্চলের আশেপাশে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তুলে পরিবেশ বিপন্ন করে--- মানুষের এমন অবিবেচনাপ্রসূত অন্যার ইচ্ছার কোন শেষ নেই! এই মহামারি করোনা ভাইরাস মানুষের জন্য একটা শিক্ষা। কিন্তু মানুষ কি এ থেকে কোন শিক্ষা গ্রহণ করবে? মহামারি শেষ হলে কি মানুষ প্রকৃতির প্রতি সদয় হবে? মনে হয় না, কারণ এই মহামারির মধ্যে মানুষের হিংস্রতা কমেনি। কয়েকদিন আগেও রাউজানের উরকিরচর ইউনিয়নে হালদা সংলগ্ন এলাকায় একটি বিরল প্রজাতির একটা ডলফিনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। মাদারীপুরে খাবারের সাথে বিষ মিশিয়ে ১৫টি বানরকে হত্যা করা হয়েছে। তবে এই সংকট থেকেও যদি মানুষ যথাযথ শিক্ষা না নেয়, প্রকৃতির উপর যথারীতি অত্যাচার অব্যাহত রাখে তাহলে ভবিষ্যতে হয়ত এর চেয়েও বড় কোন মহামারি এ পৃথিবীতে ফিরে আসবে। ধ্বংস হবে মানবসভ্যতা।
করোনা ভাইরাস প্রমাণ করেছে অর্থ, বিত্ত- সম্পদ, ক্ষমতা মানুষকে শতভাগ নিরাপত্তা প্রদান করে না। অদৃশ্য এই ভাইরাস এটাও প্রমাণ করেছে নিজে নিজে কখনও ভালো থাকা যায় না। ভালো থাকতে হলে চারপাশের মানুষ ও প্রকৃতিকেও ভালো রাখতে হয়। এতদিনে যারা দেশের সম্পদ লুট করে, দুর্নীতি করে, মানুষকে ঠকিয়ে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন এরাও আজ করোনার ভয়ে স্বেচ্ছায় বাধ্য হয়ে ঘরবন্দি আছেন। অর্থ এবং ক্ষমতা তাদের নিরাপত্তা দিতে পারেনি। অনেক বিত্তবান ও ক্ষমতাধর করোনায় আক্রান্ত হয়ে এ গ্রহ থেকে এরই মধ্যে বিদায় নিয়েছেন। অদৃশ্য করোনা ভাইরাস ধনী - দরিদ্র, জাতি- ধর্ম- বর্ণ- শ্রেণী নির্বিশেষে সবাইকে এক কাতারে দাঁড় করেছে। আমাদের দেশে যেসকল বিত্তশালী, ক্ষমতাবান দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়নে জোড় না দিয়ে, দেশের উন্নতি না ভেবে সামান্য একটু জ্বর হলেও সিঙ্গাপুর, লন্ডন, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া ও কানাডার মতো উন্নত দেশে উড়াল দিতেন তাঁরা আজ কই? সবারই এখন শেষ ভরসা কিন্তু কুমির্টোলা হাসপাতাল, নয়ত সিএমএইস! প্রকৃতির বিচারের কাছে ভিআইপি কিংবা ভিভিআইপি নেই। প্রকৃতি সবাইকে এক কাতারে দেখতে ভালোবাসে।
যাইহোক, বাংলাদেশে মার্চ মাসে প্রথম করোনা রোগী সনাক্ত হয়। এরপর থেকে সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। কয়েক দফায় এ ছুটি বাড়ানো হয়েছে। সাধারণ ছুটির দু' মাস অতিবাহিত হয়ে গেছে। লকডাউন কার্যকরী করতে দেশের আইন শৃঙ্খলা বাহিনী, বিশেষ করে বাংলাদেশ পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর সদস্যরা যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এরই মধ্যে কয়েক হাজার পুলিশ সদস্য আক্রান্ত, আক্রান্ত হয়ে কয়েকজন মারাও গেছেন। কিন্তু দুঃখজনক, লকডাউনের দুই মাসের বেশি সময় পার হলেও দেশের জনগনের মধ্যে এখনো তেমন সচেতনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। অর্থনীতির কথা বিবেচনা করে সরকারও লকডাউন শিথিল করেছে। ইতিমধ্যে অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান, কল-কারখানা খুলে দেয়া হয়েছে। ঈদকে সামনে রেখে রাজধানীর অনেক শপিংমলও খুলে দেয়া হয়েছে। এমতাবস্থায় কোন রকম স্বাস্থ্য বিধি- নিষেধ এবং সামাজিক দুরত্ব না মেনে অনেকে অপ্রয়োজনে বাইরে ঘোরাফেরা করে করোনা ঝুঁকি বাড়াচ্ছেন। ফলাফল প্রতিদিন করোনা আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সামনে ঈদ উপলক্ষ্যে সরকার যদি লকডাউন আরো শিথিল করে গণপরিবহন খুলে দিয়ে ঈদের ছুটি কাটানোর সুযোগ করে দেয় তাহলে নিশ্চিতভাবে বলা যায় বাংলাদেশের জন্য এর চেয়েও ভয়াবহতা অপেক্ষা করছে। লকডাউন শিথিল করে দফায় দফায় সাধারণ ছুটির মেয়াদ বাড়িয়ে কোন লাভ নেই। এর চেয়ে বরং কঠোরভাবে লডডাউন পালন করে দ্রুতই এ সমস্যার সমাধান করতে হবে। যত দেরি হবে ততই দেশের অর্থনীতির ক্ষতি হবে। সরকার প্রয়োজনে ঈদকে সামনে রেখে সৌদি সরকারের মতন কারফিউ জারি করতে পারে। সৌদি আরবে ঈদের দিনও কারফিউ বহাল থাকবে। ঈদ উদযাপনে করোনা সংক্রমণ যাতে না বাড়ে, তা নির্দিষ্ট করতেই সেদেশের সরকারের এমন পদক্ষেপ৷ বাংলাদেশ সরকারও এটা ভাবতে পারে। সরকারের যদি এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে মনে হয় না দেশের জনগণের মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে। সরকারকে সবার আগে দেশ ও দেশের জনগণের নিরাপত্তা ভাবতে হবে। আর দেশ ও দেশের জনগণের স্বাভাবিকতার সাথেই অর্থনীতি জড়িত। তাই সরকারকে প্রয়োজনে খুব কঠোর হয়ে করোনা ভাইরাস বিদায় করে যত দ্রুত সম্ভব দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে হবে। আর এই সংকটময় মুহূর্তের চরম শিক্ষা আমাদের কাজে লাগতে হবে। সংকট কেটে গেলে আমাদের অবহেলা ও অত্যাচারে প্রকৃতি যেন আবার প্রাণ হারিয়ে না ফেলে, বাস্তুতন্ত্র যেন বিনষ্ট না হয় সেদিকে আমাদের লক্ষ রাখাই হবে এ জাতীয় সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধান।
No comments:
Post a Comment