Tuesday, 27 September 2016

ক্রিকেটাধিপত্য ও নারী ফুটবলারের লাঞ্ছনা

বাংলাদেশে নিছক কোনো খেলা নয়, বরং মাঝে মধ্যে উৎসবের উপলক্ষ হয়ে আসে এক একটি ক্রিকেট সিরিজ। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আমাদের সাফল্য যেমন অনুপ্রাণিত হওয়ার মতো, তেমনি ক্রিকেট দলের সঙ্গে বাহারি তকমা যুক্ত হয়েছে টিম-টাইগার্স। তবে ছেলেদের ফুটবল এদেশের যখন ক্রমশ জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে, ঠিক তখনই সম্পূর্ণ স্রোতের বিপরীতে গিয়ে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশের মেয়েরা গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপ ফুটবলের চূড়ান্ত পর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে। বাছাই পর্বে চীনা তাইপেকে ৪-২ গোলে হারিয়েছে। ২০১৭ সালে থাইল্যান্ডে মূলপর্বের খেলা অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশ দলের এ সফলতায় দেশবাসী আবেগাপ্লুত। দেশের জনগণ তাদের অভিনন্দন জানাতে কৃপণতা করেনি। এমনকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য গৌরবের উপলক্ষ নিয়ে আসা এই মেয়েদের প্রশংসা করেছেন। বলতে গেলে পর পর কয়েকটি ম্যাচ জেতার পর বাংলার আকাশে-বাতাসে অনূর্ধ্ব-১৬ নারী ফুটবলারদের জয়ধ্বনি। কিন্তু সবার এই আবেগ যে ক্ষণস্থায়ী, নিছক লোক দেখানো, তা বুঝতে খুব বেশি দেরি করতে হয়নি ইতিহাস সৃষ্টিকারী নারী ফুটবলারদের।
বাংলাদেশের ফুটবল যেখানে সময়ের আবর্তে ব্রাত্য, ছেলেদের ফুটবলে একের পর এক পরাজয় যখন আমাদের থমকে দিয়েছে, তখন এই মেয়েরা বলতে গেলে আমাদের নিভে যেতে থাকা আশার প্রদীপ নতুন করে জ্বালিয়েছে। তবে এত বড় একটা অর্জনের পর কৃষ্ণা-মারিয়া-সানজিদাদের ঈদে বাড়ি যেতে লোকাল বাসের যাত্রী হতে হয়েছে। এ বাসের যাত্রী হয়ে যাত্রাপথে পদে পদে লাঞ্ছিত, অপমানিত ও অশ্লীল বাক্যের শিকার হন তারা। বাংলাদেশের একজন ক্রিকেটারকে নিয়ে যতটা চিন্তা করা হয়, তাদের নিরাপত্তা, সম্মান আর সামাজিক স্ট্যাটাস যতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, সেখানে পুরো দৈন্য দেখা গেছে এদের ক্ষেত্রে। বিশেষ করে পুরো টিমকে মাঝ রাস্তায় ছেড়ে দেয়া হয়। তাদের সঙ্গে ছিল না ফুটবল ফেডারেশনের কোনো কর্মকর্তা, এমনকি তাদের যাত্রা নির্বিঘ্ন করতেও বাংলাদেশে ফুটবল ফেডারেশন থেকে নেয়া হয়নি কোনো বিশেষ পদক্ষেপ।
এটা অনাকাঙ্খিত যে এত বড় অর্জনের পরেও ফুটবল ফেডারেশন থেকে তাদের প্রতি ঈপ্সিত সম্মানটুকু দেখানো হয়নি। ঈদের আগে পথে-ঘাটে যত রকমের দুর্ভোগ থাকে, সব ধরনের দুর্ভোগ, কটুবাক্য ও অপমান সহ্য করে বাড়ি পৌঁছেও তাদের অভিজ্ঞতা ভালো হয়নি। কলসিন্দুর গ্রামে ফুটবলার তাসলিমার বাবাকে পিটিয়েছেন এক স্কুলশিক্ষক। দেশের হয়ে খেলা কলসিন্দুরের সব মেয়েকে ঢাকার সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ না দিয়ে স্কুলের হয়ে খেলার আদেশ দিয়েছিলেন ওই শিক্ষক। কিন্তু মেয়েরা তার কথা শুনেনি। এ কারণেই নাকি প্রথমে তাসলিমাকে গালাগাল এবং পরে তার বাবাকে মারধর করা হয়! কিন্তু দেশের জন্য এত বড় সম্মান বয়ে আনার ঠিক পর পরই পদে পদে লাঞ্ছনা ও অপমান কি তাদের কাঙ্ক্ষিত ছিল? এই কি তাদের জন্য আমাদের উপহার? আর শুরুতে তাদের প্রতি দেশবাসীর যে উচ্ছসিত ভালোবাসা, তা এত দ্রুত উবে গেল? তাই ভোগান্তির শিকার এক ফুটবলার টিভি ক্যামেরার সামনে জানালেন তার যন্ত্রণার কথা ঠিক এভবেই, ‘সুন্দর একটা রেজাল্ট করলাম আমরা, বাংলাদেশের হয়ে খেললাম কিন্তু আজকে...খুব কষ্ট লাগছে। বাসের মধ্যে যাত্রীদের কাছে এভাবে অপমান, লাঞ্ছনা ও ভোগান্তির শিকার হতে হবে তা কখনই ভাবিনি।’
দেশের প্রেক্ষাপটে এ হতাশা শুধু একজন খেলোয়াড়ের নয়, এ হতাশা একজন নারীরও। পাবলিক বাসে, রাস্তায় চলার পথে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রায় প্রতিটি স্থানে নারীরা ইভ টিজিং থেকে শুরু করে নানা বঞ্চনার শিকার হন। তবে আপাতত মারিয়া-সানজিদাদের নারী হিসেবে নয়, খেলোয়াড় হিসেবে বিবেচনা করে কয়েকটি প্রশ্ন উত্থাপন করা যেতেই পারে। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, যেখানে আমাদের ক্রিকেটাররা ইচ্ছেখুশি নিজের গাড়ি হাঁকিয়ে বেড়ান, কেউ কেউ নিয়মিত হেলিকপ্টারে পর্যন্ত চড়েন, সেখানে দেশের জন্য এমন সম্মান বয়ে আনা মেয়েগুলো কেন লোকাল বাসের যাত্রী হয়ে ঈদ করতে বাড়ি যাবে? কেন পথিমধ্যে তাদের কটুবাক্য শুনতে হবে? কেন তাদের প্রতি কর্তৃপক্ষের এমন উদাসীনতা ও অবহেলা? তারা কি একটু বিশেষ সুযোগ-সুবিধা, নিরাপত্তা, সম্মান প্রত্যাশা করে না?
বাফুফের এমন নির্বোধ কর্মকাণ্ডে যারপরনাই বিরক্ত হয়েছি। অন্তত এজন্যই আর বলতে দ্বিধা নেই, দেশে একমাত্র ক্রিকেটার বাদে অন্য প্রায় সব খেলোয়াড় অবহেলিত। তাদের তেমন গুরুত্ব দেয়া হয় না। ক্রিকেটারদের মতো যদিও দেশের অন্য খেলোয়াড়রাও লাল-সবুজের পতাকা বহন করেন। দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনেন, বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। তার পরও এরা প্রায় সময়ই উপেক্ষিত।
আমাদের মানতেই হবে বিশ্বক্রিকেটে বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম এখন শক্ত অবস্থানে। এ অর্জন একদিনে হয়নি। এর পেছনে রয়েছে খেলোয়াড়দের কঠোর শ্রম, ত্যাগ ও নিষ্ঠা। আর দেশ ও দেশের জনগণের পৃষ্ঠপোষকতা। দেশে ক্রিকেটকে যে পরিমাণে সাপোর্ট দেয়া হয়, অন্য কোনো খেলায় তা দেয়া হয় না। দিনের পর দিন ক্রিকেটের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার মুখে অচ্ছুত-অবহেলিত হয়ে যাচ্ছে অন্য সব ধরনের খেলা। আমাদের জাতীয় খেলা কাবাডি থেকে শুরু করে ফুটবল, হকি, অ্যাথলেটিকস এগুলোয় কারো কোনো দৃষ্টিই যেন নেই। আমরা জানি, ক্রিকেট আজকের অবস্থানে আসতে কতটা পৃষ্ঠপোষকতা দিতে হয়েছে। তাই দেশের অন্যান্য খেলা যদি এমন পৃষ্ঠপোষকতা পেত তাহলে হয়তো আমরা সেখান থেকেও ভালো কিছু উপহার পেতাম।
বাংলাদেশের বিভিন্ন দৈনিক বাঙালি-রাশিয়ান মেয়ে মার্গারিটা মামুনকে নিয়ে মেতে আছে। কিন্তু এ মাতামাতির মধ্যে খোদ আমাদের দেশের মাটিতেই তার মতো আরো কয়েক ডজন ক্রীড়াবিদের জন্ম নেয়ার পথ রুদ্ধ করা হচ্ছে, সেদিকে কারো খেয়াল আছে কি? আমরা জানি, একমাত্র ক্রিকেটার বাদে বাকিরা কতটা অপর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার মধ্যে শুধু নিজ মেধা, দৈহিক সক্ষমতা ও যোগ্যতা দিয়ে জাতীয় পর্যায় থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক আসরে প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। তারা যেভাবে এই অপর্যাপ্ত সুবিধার মধ্যেও দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনেন তা-ইবা কম কিসে! সম্প্রতি অনুষ্ঠিত রিও অলিম্পিকে বাংলাদেশ থেকে সাতজন খেলোয়াড় অংশগ্রহণ করেছেন। এর মধ্যে একজন সাঁতারু মাহফিজুর রহমান সাগর। অলিম্পিক থেকে দেশে ফিরে বাড়ি যাওয়ার পথে ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন তিনি। গণমাধ্যমে এ সংবাদ প্রকাশ না হলেও ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে ঘটনাটি আমি জানি। এই হচ্ছে দেশের একজন খেলোয়াড়ের নিরাপত্তা অবস্থা! গত লন্ডন অলিম্পিকে এই মাহফিজুর রহমান সাগরই বাংলাদেশের পতাকা বহন করেছিলেন। খেলোয়াড়রা দেশের প্রতিনিধি। লাল-সবুজের পতাকা তারা বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেন। এসবের বিনিময়ে তারা আমাদের কাছে কিছু চান না। কিন্তু কৃতজ্ঞ জাতি হিসেবে আমরা তাদের প্রতি একটু সম্মান তো দেখাতে পারি। এটা আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। অথচ দেশের মাটিতে মারিয়া-সানজিদাদের অপমানিত হতে হয়। দেশসেরা সাঁতারু মাহফিজুর রহমান সাগর অলিম্পিক থেকে দেশে এসে বাড়ি ফেরার পথে ছিনতাইয়ের শিকার হন। বিষয়গুলো ভাবতেই লজ্জা লাগে। আমাদের মানসিক দৈন্য কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে! নিঃসন্দেহে এ দৈন্য হতাশার জন্ম দেয়। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন, যে দেশে গুণীর কদর নেই, সে দেশে গুণী জন্মাতে পারে না। আর অনাগত সময় এমনই এক ভয়াবহতারই ইঙ্গিত দিচ্ছে আমাদের। আগে থেকে সতর্ক না হলে বাংলাদেশে একমাত্র ক্রিকেট বাদে আর কোনো খেলাধুলায় কারো আগ্রহ থাকবে বলে মনে হয় না। তখন বিশ্বের সব দেশ অলিম্পিক থেকে মেডেলের পসরা নিয়ে ঘরে যাবে, আর দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে আমাদের অসহায়ত্বের প্রহর।
এই লেখাটি বণিক বার্তা পত্রিকায় ২৭/০৯/২০১৬ ইং প্রকাশিত।

No comments:

Post a Comment