ইউক্রেনের ক্রাইমিয়াকে কেন্দ্র করে রাশিয়ার সঙ্গে আমেরিকা ও তার ইউরোপীয় মিত্রদের সম্পর্ক এমনিতেই শীতল। নতুন করে সিরিয়া ইস্যুকে কেন্দ্র করে বিশ্বের পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র
ও রাশিয়া এখন সরাসরি মুখোমুখি অবস্থানে। রাশিয়ার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সিরিয়ায় তাদের অভিযানের উদ্দেশ্য সেনাবাহিনীকে সমর্থন দেয়া এবং আইএস ও উগ্রপন্থী দলগুলোকে লক্ষ্য করে হামলা চালানো। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা আইএস দমনে রাশিয়া যে সাফল্য দাবি করেছে, তাতে দ্বিমত পোষণ করে বলছে, সিরিয়ায় আইএস দমনের নামে আসলে প্রেসিডেন্ট আসাদকেই বাঁচাতে চাইছেন পুতিন। তাদের বক্তব্য, হামলা চালানোর সময় রাশিয়া আইএস ও সিরিয়ার সরকারবিরোধী মধ্যপন্থীদের মধ্যে বাছবিচার করছে না। দুই দেশের এমন পরস্পরবিরোধী বক্তব্য উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। এর মধ্যে আগুনে ঘি দেয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে— তুরস্কের আকাশসীমায় রুশ যুদ্ধবিমানের প্রবেশ এবং কাস্পিয়ান সাগর থেকে রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র হামলা।
এখন রাশিয়ার বিরুদ্ধে একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্রদের অঘোষিত ব্যাপক রণপ্রস্তুতি চলছে। অন্যদিকে রাশিয়া ও তার মিত্রদের তীব্র বিরোধিতা করছে। সিরিয়াকে কেন্দ্র করে দু’পক্ষের এমন চাপা উত্তেজনার ফলে বিশ্বরাজনীতি অনেকটাই উত্তপ্ত। মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের ক্ষেত্রে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সিরিয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে কৌশলগত দিক দিয়ে এক্ষেত্রে রাশিয়া এগিয়ে রয়েছে। এছাড়া সিরিয়ার সঙ্গে রাশিয়ার অর্থনৈতিক সম্পর্কও রয়েছে। আরব দেশগুলোর মধ্যে সিরিয়া হলো রাশিয়ার প্রধান অস্ত্র ক্রেতা। সর্বোপরি সিরিয়ার আসাদ সরকার রাশিয়ার মতো পশ্চিমাবিরোধী। তাই রাশিয়া কখনই সিরিয়াকে হাতছাড়া করতে চাইবে না। এজন্যই পুতিন সরকার আসাদ সরকারের পাশে রয়েছে এবং শুরু থেকে জাতিসংঘে যেকোনো সিরিয়াবিরোধী প্রস্তাবে ভেটো দিচ্ছে।
সিরিয়ার এ অভ্যন্তরীণ সংকটকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রসহ পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশ ইসরায়েল ও তুরস্ক নিজেদের কর্তৃত্ব নিশ্চিত করার ব্যাপারে তত্পর। কৌশলে সিরিয়া দখল করতে পারলেই মধ্যপ্রাচ্যের ওপর তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হবে। সিরীয়দের স্বার্থে নয়, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র মূলত ঘোলা পানিতে মাছ শিকারে ব্যস্ত। ফলে বিশ্বরাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে সিরিয়ায় খেলা জমে উঠেছে। তবে এ খেলায় বলি হচ্ছে সাধারণ মানুষ। শিক্ষায়-দীক্ষায়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে আরব দেশগুলোর মধ্যে অগ্রগামী একসময়ের সিরিয়া দিন দিন ধ্বংসের পথে এগোচ্ছে। এখন সিরিয়ায় যা হচ্ছে তা ভয়াবহ। চারদিকে শুধুই ধ্বংসস্তূপ। প্রিয়জন হারানো মানুষের আর্তনাদে সিরিয়ার বাতাস ভারী। অনেকেই প্রিয় স্বদেশ ছেড়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে অন্য দেশে রিফিউজি হয়েছে। অনেকে সীমান্ত পাড়ি দিতে গিয়ে প্রাণ হারাচ্ছেন।
অশান্ত সিরিয়ায় শান্তির বারতা কবে আসবে, আদৌ আসবে কিনা, বারবার এমন প্রশ্ন মনে জাগছে। দেশটির অবনতিশীল রাজনৈতিক বিষয়ে বিশ্বমোড়লদের তত্পরতা দেখা গেলেও বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে কোনো উদ্যোগ লক্ষ করছি না। বরং সংকট পুঁজি করে বিশ্বমোড়লের দল নিজ নিজ স্বার্থ হাসিলে ব্যস্ত। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ সংকটের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে বিশ্বের প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলো। ফলে সমস্যাটি নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। বিশ্বের পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া যেভাবে মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে, তাতে এ স্নায়ুযুদ্ধ থেকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ না শুরু হয়। সিরিয়া প্রশ্নে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মতপার্থক্য থাকলেও এজন্য কেউই ছায়াযুদ্ধে অংশ নেবে না— যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার এমন বক্তব্যে আশ্বস্ত হওয়া যাচ্ছে না।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ সিরিয়া পরিস্থিতি নিয়ে এরই মধ্যে বেশ কয়েকবার মিটিং করেছে। বিশ্বের সবাই এক সুরে বর্তমান অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সমাধানের জন্য মুখে মানবতা ও শান্তির কথা বললেও কার্যত কোনো কিছুই হয়নি। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি দিন দিন আরো খারাপ হচ্ছে। সিরিয়া সংকট থেকে যদি বিশ্বরাজনীতিতে বড় ধরনের কোনো সংকট সৃষ্টি হয়, তা হবে খুবই ভয়াবহ। যুদ্ধংদেহী মনোভাব নয়, একমাত্র শান্তিকামী মনোভাবই পারে বিশ্ববাসীকে এ ভয়াবহতার হাত থেকে রক্ষা করতে। লেখা শেষ করব জাতিসংঘের অন্যতম সহযোগী সংগঠন ইউনেস্কোর সংবিধানের একটি বিখ্যাত উক্তি দিয়ে। ‘যেহেতু যুদ্ধের সূত্রপাত হয় মানুষের মনে, সেহেতু মনের মধ্যেই গড়ে তুলতে হবে শান্তিরক্ষা প্রাচীর।’ বিশ্বনেতারা যদি বাস্তব জীবনে এটা গড়ে তুলতে না পারেন, তাহলে ‘বিশ্বশান্তি’ কথাটি শুধু অক্ষরমালা হয়ে সফেদ কাগজের পাতায়ই আজীবন শোভা পেতে থাকবে। আর আধুনিক অস্ত্র ও বোমার আঘাতে প্রতিনিয়ত ক্ষত-বিক্ষত হতে থাকবে বিশ্বমানবতা।
No comments:
Post a Comment