গতকাল ৪ জানুয়ারি ছিল বাংলাদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের জন্মদিন। আজ থেকে ৬৮ বছর আগে ১৯৪৮ সালের এদিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে নাঈমউদ্দিন আহমেদকে আহ্বায়ক করে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে দেশের ঐতিহ্যবাহী এ ছাত্রসংগঠনটি জন্মলাভ করে। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে সংগঠনটির নাম ছিলো ‘ পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ’। স্বাধীনতার পর সংগঠনটির নাম পরিবর্তন করে ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’ করা হয়। দেশের ঐতিহ্যবাহী ও সংগ্রামী ছাত্র সংগঠন হিসেবে দেশের ইতিহাসের সাথে নিবিড়ভাবে এই ছাত্র সংগঠনের নাম জড়িয়ে আছে। এই ছাত্র সংগঠনের অনেক নেতা-কর্মী ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২’র শিক্ষা কমিশন আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান,এগারো দফা আন্দোলনসহ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় স্বাধিকার আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। বর্তমান জাতীয় রাজনীতির অনেক শীর্ষ নেতার রাজনীতিতে হাতেখড়িও এই ছাত্র সংগঠন থেকেই। জাতির জনকের হাতে গড়া ছাত্র সংগঠনটির অতীত অতি গৌরবের। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! সময়ের বিবর্তনে আর নীতিহীন রাজনীতির কবলে পড়ে ব্যক্তি স্বার্থের কাছে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের সময় অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী ঐতিহ্যবাহী এই ছাত্র সংগঠনটি এখন আর্দশ বিচ্যুত হয়ে সর্বদাই সমালোচিত ! বিগত সময়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী জুবায়ের আহমেদ হত্যা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দু’পক্ষের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে ছাত্রলীগের নেতা আবদুল্লাহ আল হাসান সোহেলের মৃত্যু,চট্টগ্রামে রেলের দরপত্র জমা দেয়া নিয়ে যুবলীগ-ছাত্রলীগের মধ্যে গোলাগুলিতে আট বছরের শিশু আরমান হোসেন ও যুবক সাজু পালিতের মৃত্যু, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের দু’পক্ষের মারামারিতে রাব্বী নামে এক শিশুর মৃত্যু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এ এফ রহমান হলের ছাত্রলীগের দু’পক্ষের সংঘর্ষের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের মেধাবী ছাত্র আবু বকরের মৃত্যু, ঐতিহ্যবাহী সিলেট এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে আগুন, দর্জি দোকানি বিশ্বজিত্ দাসকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করাসহ এমন অসংখ্য নিন্দনীয় ঘটনার জন্ম দিয়ে বারবার গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে দেশের ঐতিহ্যবাহী এই ছাত্র সংগঠনটি। রাজনীতির মাঠে বর্তমানে প্রতিপক্ষ নেই বললেই চলে। কিন্তু তারপরও কেন জানি এ ছাত্র সংগঠনের অনেক নেতা-কর্মীর মধ্যে বিন্দুমাত্র সহনশীলতা নেই। গণতন্ত্রের চর্চা নেই। বিগত সময়ে অভ্যন্তরীণ কলহের জের ধরে বহুবার এরা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। এসব সংঘর্ষে নিজ দলের নেতা-কর্মীসহ দেশের নিরপরাধ সাধারণ মানুষও রক্ষা পায়নি। এছাড়া সংগঠনটির বিভিন্ন নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে টেন্ডারবাজি, ধর্ষণ,অপহরণ, জমি দখল, চাঁদাবাজি, দরপত্র নিয়ন্ত্রণ, ভর্তিবাণিজ্য, ছিনতাই, রাহাজানি, খুন,গোলাগুলি যেন নিত্যদিনের সংবাদ ! গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে (১১ আগস্ট ২০১৫) পর্যন্ত এই সাড়ে সাত বছরে ছাত্রলীগ নিজেদের মধ্যে বা অন্য সংগঠনের সঙ্গে কমপক্ষে ৫০০টি সংঘর্ষে জড়িয়েছে। এতে নিহত হয়েছে অন্তত ৫৮ জন। নিজ সংগঠনের ৩৯ জনের বাইরে বাকি ১৫ জনের মধ্যে দুটি শিশু এবং অন্যরা প্রতিপক্ষ সংগঠনের কর্মী বা সাধারণ মানুষ। এসব সংঘর্ষে আহত হয়েছে দুই হাজারের বেশি মানুষ। সামপ্রতিক সময়ে সাধারণ নিরীহ মানুষ, শিক্ষক, পুলিশ সাংবাদিক কেউ-ই এদের হাতে প্রহূত হওয়া থেকে বাদ পড়েনি ! এমনকি পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়স্থল মাতৃগর্ভও এদের হামলা থেকে রক্ষা পায়নি ! ছাত্রলীগের বর্তমান কর্মকাণ্ডে শুধু দেশের জনগণ না, আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মীও বিরক্ত। বিগত সময়ে বিভিন্ন নেতার বক্তব্যে এসব বিরক্তির কথা উঠেও এসেছে। কিন্তু তারপরও নেতা-কর্মীর অন্যায় কর্মকাণ্ড থেমে নেই। জাতির জনকের হাতে গড়া ঐতিহ্যবাহী এই ছাত্র সংগঠনটির কি করুণ দশা ! ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ এখন ক্রমান্বয়ে উন্নতির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। অস্বীকার করার সুযোগ নেই অন্যান্য সময়ের তুলনায় দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এখন অনেক ভালো। বাংলাদেশ এখন নিম্ন মধ্যম-আয়ের দেশ। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হয়েছে। নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের রোল মডেল। কিন্তু বিগত সময়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগের বিভিন্ন নেতা-কর্মীর বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে সরকারের এসব সাফল্যের সংবাদ ম্লান করে দিচ্ছে। নতুন বছরে এ ছাত্র সংগঠনের কোন নেতা-কর্মী নিজেকে নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে জড়াবে না - এমনটাই প্রত্যাশা। দেশের শান্তিকামী মানুষ নতুন বছরে ঐতিহ্যবাহী এ ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীদের মাঝে সহনশীল আচরণ প্রত্যাশা করে।
এ দেশের মানুষ অস্ত্রের
ঝনঝনানি দেখতে চায় না। পেশীশক্তির মহড়া দেখতে চায় না। দেশের মানুষ
বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ের সেই ছাত্রলীগ দেখতে চায়। প্রিয়
দেশ ও দেশের জনগণের কল্যাণে যারা সর্বদা নিবেদিত থাকবে। দেশের ঐতিহ্যবাহী
এই ছাত্র সংগঠনের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারের জন্য, দেশের ভবিষ্যত্ রাজনীতির
গুণগত মান বৃদ্ধি, শিক্ষাঙ্গনের সুষ্ঠু পরিবেশ রক্ষা এবং সামাজিক
স্থিতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে এর কোন বিকল্প নেই।
No comments:
Post a Comment