শ্রাবণের পড়ন্ত বিকেলে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। নৈসর্গিক সৌন্দর্যের মাঝে এক শান্ত নীরবতা। এমন মন ভুলানো আবেশে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আড্ডাস্থল খ্যাত ট্রান্সপোর্ট চত্বরের পাশে লাল ইটের গাঁথুনিতে গড়া বাঁধন অফিসে কিছু শিক্ষার্থী আড্ডায় মশগুল। প্রতিদিনই পৃথিবীর বুকে সন্ধ্যা নামার আগে ওরা এখানে এসে মিলিত হয়। একে অন্যের সঙ্গে খোশগল্পে মেতে ওঠে। কিন্তু আড্ডা দেওয়া তাদের মূল উদ্দেশ্য নয়। সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে, বিবেকের তাড়নায়, বিপদগ্রস্ত মানুষকে সেবাদানের মানসিকতা নিয়ে বাঁধন অফিসে প্রতিদিনই এরা উপস্থিত হয়। আড্ডার মাঝখানে রুক্ষ চুলের জীর্ণ পোশাক পরিহিত এক ব্যক্তি হাজির। চোখেমুখে তাঁর দুশ্চিন্তায় স্পষ্ট ছাপ। তাঁর সহধর্মিণী হাসপাতালে শয্যাগত। আজ রাতেই স্ত্রীর অপারেশন হবে। এ জন্য দুই ব্যাগ ও নেগেটিভ রক্তের প্রয়োজন। কিন্তু কোথাও তিনি রক্ত খুঁজে পাচ্ছেন না। তাঁর আর্থিক সামর্থ্যও নেই কোন ব্লাড ব্যাংক থেকে রক্ত কিনবেন। জাবি বাঁধন অফিসে এসেছেন রক্তের সন্ধানে। প্রতিদিনই এমন অসংখ্য মানুষ রক্তের প্রয়োজনে ছুটে আসে এখানে। এটি শুধু জাবি বাঁধন শাখার প্রাত্যহিক চিত্র নয়। দেশের প্রতিটি বাঁধন কেন্দ্রে এমন অসংখ্য মানুষ প্রতিদিনই রক্তের প্রয়োজনে আসে এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বাঁধনকর্মীদের দ্বারা উপকৃত হয়।
স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের দ্বারা পরিচালিত স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের একটি সংগঠন ‘বাঁধন’। এটি সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক ও অরাজনৈতিক একটি স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক সংগঠন। এই সংগঠনের কর্মীরা স্বেচ্ছায় রক্তদানে উদ্বুদ্ধকরণের জন্য নবীন শিক্ষার্থীদের রক্তদানের উপকারিতা সম্পর্কে অবহিত করে। সচেতনতামূলক পোস্টারিংয়ের আয়োজন করে। প্রতিবছর রক্তদাতাদের জন্য ডোনার সংবর্ধনার আয়োজন করে। এসবের পাশাপাশি সংগঠনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বিভিন্ন সেবা প্রদান ও জনগণের মধ্যে অজ্ঞতা দূর করে নানাবিধ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে সুস্থ সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে তারা।
প্রায় ১৯ বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলে ‘বাঁধন’-এর জন্ম। বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ, পিজি হাসপাতাল ও বারডেমসহ বেশ কিছু চিকিৎসাকেন্দ্রের অবস্থান হওয়ায় প্রায় প্রতিদিনই জরুরি রক্তের প্রয়োজনে অনেকেই ছাত্রাবাসে রক্তের সন্ধান আসত। ছাত্রাবাসের গেটে এসে রক্তের প্রয়োজনে অনেকে কান্নাকাটি করত। কখনো রোগীর আত্মীয়স্বজন হল গেটে ‘রক্ত চাই’ শিরোনামে নোটিশ লাগিয়ে দিত। ভাগ্যগুণে অনেকে রোগীর জন্য প্রয়োজনীয় রক্ত পেত। অনেকে ব্যর্থ হয়ে হতাশ হয়ে ফিরে যেত। বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য ছাত্রছাত্রী পরিচিত/অপরিচিত অনেক রোগীর জন্য প্রায়ই স্বেচ্ছায় রক্তদান করত। কিন্তু এই রক্তদান সীমাবদ্ধ ছিল। কারণ বেশির ভাগ শিক্ষার্থী তখন নিজের রক্তের গ্রুপই জানত না। নিয়মিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর শিক্ষার্থীদের স্বেচ্ছায় রক্তদান কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত রাখার মতো কোনো কাঠামোগত সাংগঠনিক উদ্যোগও ছিল না। ঠিক সেই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যারয়ের কিছুসংখ্যক শিক্ষার্থী ব্যক্তিগত উদ্যোগে বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর তাগিদ অনুভব করে। ১৯৯৭ সালে শহীদুল্লাহ হলের একজন আবাসিক ছাত্র তাঁর বন্ধুদের কাছে স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের একটি সংগঠন খোলার প্রস্তাব রাখেন। মহৎ এ প্রস্তাবে সবাই রাজি হয়। হলের একটি কক্ষে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর সংগঠনটির একটি নাম চাওয়া হয় সবার কাছে। কয়েকটি প্রস্তাবিত নামের মধ্য থেকে একটি নাম ‘বন্ধন’ সবার পছন্দ হয়। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক ছাত্রদের একটি সংগঠনের নাম বন্ধন থাকায় বন্ধনের অপভ্রংশ করে ‘বাঁধন’ নামটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।
বেশির ভাগ শিক্ষার্থী তখন তাদের রক্তের গ্রুপ জানে না। এ অবস্থায় সংগঠনের সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বিনা মূল্যে রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা করার ব্যবস্থা করা হবে। তারিখ নির্ধারিত হয় ১৯৯৭ সালের ২৪ অক্টোবর। দিনটি ছিল শুক্রবার। বাঁধনের ইতিহাসে ওই দিনটিই সংগঠনের আত্মপ্রকাশের দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। বিনা মূল্যে রক্তের গ্রুপ নির্ণয়ের মাধ্যমে সংগঠনটির আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ ঘটে। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব হলে অভিন্ন পদ্ধতিতে সংগঠনটির কার্যক্রম শুরু হয়। বিস্তৃতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সবার মধ্যে বৃহত্তর সাংগঠনিক যোগাযোগের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলে ১৯৯৮ সালের ৩১ অক্টোবর শাহিদুল ইসলাম রিপনকে আহ্বায়ক করে কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটি গঠিত হয়। এ কমিটি কয়েকটি নতুন ইউনিট খোলাসহ গঠনতন্ত্র প্রণয়ন ও পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় কমিটি নির্বাচন সম্পন্ন করে এবং ১৯৯৯ সালের ১০ আগস্ট নতুন কমিটির কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করে। এরপর থেকে নিয়মিতভাবে প্রতিবছর বাঁধনের কেন্দ্রীয়, জোনাল ও ইউনিট পর্যায়ে প্রায় ১২০টি কমিটি প্রতিবছর নতুন করে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় গঠিত হয়ে আসছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্কালীন উপাচার্য অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী টিএসসিতে বাঁধনের কেন্দ্রীয় অফিস হিসেবে একটি কক্ষ প্রদান করেন। অরাজনৈতিক সামাজিক সংগঠন হিসেবে বাঁধন সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে ২০০১ সালের ৮ জুন রেজিস্ট্রেশন সনদ লাভ করে। বর্তমানে বাঁধন দেশের ১৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, ৩৬টি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজসহ মোট ৫১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ১০০টি ইউনিট ও ১৫টি পরিবারের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের স্বেচ্ছায় রক্তদানে উদ্বুদ্ধ করে যাচ্ছে।
বাঁধনের প্রতিষ্ঠাতা শাহিদুল ইসলাম রিপন বলেন, ‘আমাদের দেশে প্রতিবছর অসংখ্য রোগী রক্তের অভাবে মারা যায়। অসংখ্য রক্তদাতা থাকা সত্ত্বেও প্রয়োজনে সময়মতো রক্ত পাওয়া যায় না, ক্ষেত্রবিশেষে অসম্ভবও বটে। বাঁধন প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ অবস্থার অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানে রক্তের অভাবে কোনো অসহায় দুস্থ রোগীর জীবন প্রদীপ নিভে যায় না। আজ অসহায় দুস্থ মুমূর্ষু রোগীর রক্তের প্রয়োজনে বাঁধন একটি নির্ভরতার নাম।’
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. আজম বলেন, ‘বাঁধন আগামী ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় এর কার্যক্রম চালু করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। স্বেচ্ছায় রক্তদানে শরীরের কোনো ক্ষতি হয় না, এই বার্তাটি আমরা সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে চাই। জনমনে এ সচেতনতা সৃষ্টি করতে পারলেই আমাদের স্বপ্ন পূরণ হবে। শহীদের রক্ত দিয়ে অর্জিত এই মাতৃভূমির বুকে রক্তের অভাবে আর একটি মানুষেরও জীবনের বাতি যেন নিভে না যায়।’
No comments:
Post a Comment