সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এএফসি অনুর্ধ্ব-১৬ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশের মেয়েরা গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপ ফুটবলের চূড়ান্তপর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে। বাছাইপর্বে চীনা টাইপেকে ৪-২ গোলে হারিয়েছে। ২০১৭ সালে থাইল্যান্ডের মূল পর্বের খেলা অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশ দলের এই সফলতার দেশবাসী আবেগে আপ্লুত। দেশের জনগণ তাদের অভিনন্দন জানাতে কৃপণতা করেনি। বাংলার আকাশে বাতাসে অনুর্ধ্ব-১৬ নারী ফুটবলারদের জয়ধ্বনি। কিন্তু বাঙালির এ আবেগ যে ক্ষণস্থায়ী, নিছক লোক দেখানো তা বুঝতে খুব বেশি দেরি করতে হয়নি ইতিহাস সৃষ্টকারী নারী ফুটবলারদের। মাত্র দু'দিনের ব্যবধানে বাঙালি তাদের প্রাপ্য বুঝিয়ে দিয়েছে! এত বড় একটা অর্জনের পর মারিয়া সানজিদাদের ঈদে বাড়ি যেতে লোকাল বাসের যাত্রী হতে হয়েছে। শুধু তাই নয়, যাত্রা পথে হতে হয়েছে লাঞ্ছিত, অপমানিত ও অশ্লীল বাক্যের শিকার। তাদের সাথে ছিল না ফুটবল ফেডারেশনের কোন কর্মকর্তা, এমনকি তাদের যাত্রা নির্বিঘ্ন করতে ফেডারেশন থেকে নেয়া হয়নি কোন পদক্ষেপ। ফেডারেশন থেকে যদি একটা মাইক্রোবাস ভাড়া করেও তাদের বাড়ি পাঠানোর উদ্যোগ নিতো, তাহলেও কিন্তু মেয়েগুলোর এভাবে পথে অপমানিত হতে হয় না। দুঃখজনক এত বড় অর্জনের পরেও ফুটবল ফেডারেশন থেকে তাদের প্রতি নূন্যতম ভদ্রতা দেখানো হয়নি। ঈদের আগে পথেঘাটে যত রকমের দুর্ভোগ থাকে সব ধরনের দুর্ভোগ, কটুবাক্য ও অপমান সহ্য করে বাড়ি পৌঁছেও তাদের অভিজ্ঞতা ভালো হয়নি। কলসিন্দুর গ্রামে ফুটবলার তাসলিমার বাবাকে পিটিয়েছে এক স্কুলশিক্ষক৷ দেশের হয়ে খেলা কলসিন্দুরের সব মেয়েকে ঢাকার সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ না দিয়ে স্কুলের হয়ে খেলার আদেশ দিয়েছিলেন ঐ স্কুলশিক্ষক৷ কিন্তু মেয়েরা তাঁর কথা শুনেনি। এ কারণেই নাকি প্রথমে মেয়েকে গালাগাল এবং তারপর তাঁর বাবাকে মারধর! পত্রিকায় পড়লাম স্কুল থেকেও নাকি তাদের বিতাড়িত করা হবে! দেশের জন্য এত বড় সম্মান বয়ে আনার পর প্রতিটি পদে পদে লাঞ্ছনা ও অপমান। এই হচ্ছে তাদের উপহার! তাদের প্রতি বাঙালির ভালোবাসা! "এত সুন্দর একটা রেজাল্ট করলাম আমরা, বাংলাদেশের হয়ে খেললাম কিন্তু আজকে.........খুব কষ্ট লাগছে।" বাসের মধ্যে যাত্রীদের কাছে অপমান, লাঞ্ছনা ও ভোগান্তির শিকার হয়ে টিভি ক্যামেরার সামনে কথাগুলো বলেছেন কলসিন্দুরের এক নারী ফুটবলার। দেশের প্রেক্ষাপটে এ হতাশা শুধু একজন খেলোয়ারের না, এ হতাশা একজন নারীর। পাবলিক বাসে, রাস্তায় চলার পথে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রায় প্রতিটি স্থানেই নারীরা ইভটিজিং এর শিকার হয়। অপমান ও লাঞ্ছনার শিকার হয়ে অনেকে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চিরবিদায় নিতে বাধ্য হয়। যাইহোক, এ বিষয়ে আলোচনায় যাবো না। আপাতত মারিয়া সানজিদাদের নারী হিসেবে না, খেলোয়ার হিসেবে বিবেচনা করে কয়েকটি প্রশ্ন করতে চাই। দেশের জন্য এমন সম্মান বয়ে আনা মেয়েগুলো কেন লোকাল বাসের যাত্রী হয়ে ঈদ করতে বাড়ি যাবে? কেন পথমধ্যে তাঁরা কটুবাক্যের শিকার হবে? কেন তাদের প্রতি কর্তৃপক্ষের এমন উদাসীনতা ও অবহেলা ? তাঁরা কী একটু বিশেষ সুযোগ - সুবিধা, নিরাপত্তা, সম্মান প্রত্যাশা করে না? বাফুফের এমন কান্ডজ্ঞানহীন কর্মকাণ্ডে যারপরনাই বিরক্ত হয়েছি। বলতে দ্বিধা নেই দেশে একমাত্র ক্রিকেটার বাদে অন্যান্য প্রায় সকল খেলোয়ার অবহেলিত। তাদের তেমন গুরুত্ব দেয়া হয় না। ক্রিকেটারদের মত যদিও দেশের অন্যান্য খেলোয়াররাও লাল সবুজের পতাকা বহন করেন। দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনেন, বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। কিন্তু তারপরও এরা প্রায় সময়ই উপেক্ষিত। ক্রিকেটার বাদে অন্যান্য খেলোয়ারদের জন্য বিমানবন্দরে কেউ ফুলের মালা নিয়ে অপেক্ষায় থাকে না ; তাদের অর্জনের জন্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বিশেষ কোন উপহার ঘোষণা করা হয় না। অস্বীকার করছি না দেশের অন্যান্য খেলার তুলনায় ক্রিকেট অনেক দূরে এগিয়ে গেছে। বিশ্ব ক্রিকেটে বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম এখন শক্ত অবস্থানে। এ অর্জন একদিনের না। এর পিছে রয়েছে খেলোয়ারদের কঠোর শ্রম, ত্যাগ ও নিষ্ঠা। আর দেশ ও দেশের জনগণের পৃষ্ঠপোষকতা। দেশে ক্রিকেটকে যে পরিমাণে সাপোর্ট দেয়া হয় অন্যান্য কোন খেলায় তা দেয়া হয় না। দেশে অন্যান্য খেলা যদি এমন পৃষ্ঠপোষকতা পেতো তাহলে হয়ত আমরা সেখান থেকেও ভালো কিছু উপহার পেতাম। অপর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার মাঝেও এরা নিজ মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে আন্তর্জাতিক আসরে প্রতিযোগিতা করে। দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনে। এই বা কম কিসে! সম্প্রতি অনুষ্ঠিত রিও অলিম্পিকে বাংলাদেশ থেকে সাতজন খেলোয়ার অংশগ্রহণ করেছেন। এর মধ্যে একজন সাঁতারু মাহফিজুর রহমান সাগর। অলিম্পিক থেকে দেশে ফিরে বাড়ি যাওয়ার পথে ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন। গণমাধ্যমে এ সংবাদ প্রকাশিত না হলেও ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে ঘটনাটি আমি জানি। এই হচ্ছে দেশের একজন খেলোয়ারের নিরাপত্তা অবস্থা! গত লন্ডন অলিম্পিকে এই মাহফিজুর রহমান সাগর -ই বাংলাদেশের পতাকা বহন করেছিলেন। খেলোয়াররা দেশের প্রতিনিধি। লাল সবুজের পতাকা তাঁরা বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেন। এসবের বিনিময়ে তাঁরা আমাদের কাছে কিছু চান না। কিন্তু কৃতজ্ঞ জাতি হিসেবে আমরা তাদের প্রতি একটু সম্মান তো দেখাতে পারি। এটা আমাদের দায়িক্ত ও কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। অথচ দেশের মাটিতে মারিয়া সানজিদাদের অপমানিত হতে হয়। দেশসেরা সাঁতারু মাহফিজুর রহমান সাগর অলিম্পিক থেকে দেশে এসে বাড়ি ফেরার পথে ছিনতাইয়ের শিকার হন। বিষয়গুলো ভাবতেই লজ্জা লাগে। আমাদের মানসিক দৈন্যতা কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে! নিঃসন্দেহে এ দৈন্যদশা অবস্থা হতাশার জন্ম দেয়। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন, যে দেশে গুনীর কদর নেই সে দেশে গুনী জন্মাতে পারে না। ঘটে যাওয়া এমন কিছু ঘটনা বিশ্লেষন করলে বোঝা যায় আমাদের দেশে গুনীদের কদর আসলে কতটুকু!
No comments:
Post a Comment