Saturday, 2 January 2016

'মুখোমুখি আমি, খোকা আর বৃদ্ধাশ্রম'

পৃথিবীর প্রথম বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রাচীন চীনে। গৃহছাড়া অবহেলিত ও অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্রের এ উদ্যোগ ছিল শান রাজবংশের। খ্রিস্টপূর্ব ২২০০ শতকে পরিবার থেকে বিতাড়িত বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য আলাদা এই আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করে ইতিহাসে বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছে শান রাজবংশ। প্রাচীন চীনে শান রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত বৃদ্ধাশ্রমের ধারণা বর্তমান সমগ্র বিশ্বে প্রসার লাভ করেছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। বার্ধক্যে সবার জন্য শারীরিক-মানসিক সুস্থতা ও স্বস্তিময় জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে ডা. একেএম আবদুল ওয়াহেদের উদ্যোগে ১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ ও জরাবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান। সরকারি উদ্যোগে ১৯৮৫ সালে ঢাকার আগারগাঁওয়ে নিজস্ব ভবন এবং পরে ১৯৯৩-৯৪ সালে সরকারি অনুদানে হাসপাতাল ও হোম ভবন নির্মাণ করা হয়। বর্তমানে দেশব্যাপী প্রতিষ্ঠানটির ৫০টি শাখা রয়েছে। এ ছাড়া কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, যেমন_ অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী কল্যাণ সমিতি, ব্র্যাক, ইআইডি, প্রবীণ অধিকার ফোরাম প্রভৃতি প্রবীণদের কল্যাণে কাজ করে।
বৃদ্ধাশ্রম মূলত ওই সব প্রবীণের জন্য, যাদের সন্তানাদি নেই, নেই কোনো আত্মীয়-স্বজন। কিন্তু বর্তমান বৃদ্ধাশ্রমে যে সব প্রবীণ বসবাস করেন তাদের অধিকাংশেরই সন্তানাদি এবং আত্মীয়-স্বজন আছেন। এসব প্রবীণ অধিকাংশই সন্তান কর্তৃক দুর্ব্যবহার কিংবা নির্যাতনের শিকার। সন্তান শ্রদ্ধাবোধ ও কর্তব্যবোধ হারিয়ে মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে যায়। শেষ বয়সে মানুষ চায় তার সন্তান, নাতি-নাতনিদের সঙ্গে একসঙ্গে বসবাস করতে। জীবনের আনন্দঘন মুহূর্ত ভাগাভাগি করতে। কিন্তু অনেকেরই তা হয় না। পাশ্চাত্যে বৃদ্ধাশ্রম একেবারে স্বাভাবিক। সন্তান প্রাপ্তবয়স্ক হলেই সে স্বাধীন, অনেকটা মা-বাবার নিয়ন্ত্রণমুক্ত। অন্যদিকে মা-বাবা যখন একেবারে বয়সের ভারে বৃদ্ধ তখন তাদের আশ্রয় প্রবীণ আবাসন কেন্দ্র তথা বৃদ্ধাশ্রম অথবা অনেকে থাকেন নিঃসঙ্গ। তার নিত্যসঙ্গী হয়ে যায় কুকুর বা অন্য কোনো প্রাণী। একান্ত আপনজন ব্যস্ত সন্তানরা বৃদ্ধ মা-বাবাকে দেখতে যাওয়ার জন্য 'মাদারস ডে', 'ফাদারস ডে' পালন করে। কিন্তু আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে এরূপ ধারণা কি সামঞ্জস্যপূর্ণ?
আমাদের সমাজে একটি প্রবাদ বাক্য আছে_ যদি কিছু জানতে চাও, তিন মাথার কাছে যাও। এই তিন মাথা বলতে বোঝায় আমাদের প্রবীণ সমাজ। অথচ এই প্রবীণ জনগোষ্ঠী আজ চরম দুঃখ-দুর্দশায়। অসহায় ও বঞ্চনার মধ্যে অতিবাহিত হচ্ছে তাদের জীবন। আধুনিক যুগে এসে মানুষের মানবিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতা বাড়ার কথা কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এগুলো বর্তমানে আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে। গত ২৪ অক্টোবর জাতীয় সংসদে পাস করা হয় পিতা-মাতা ভরণপোষণ বিল-২০১৩। বিলে বলা হয়েছে, প্রত্যেক সন্তানকে পিতামাতার সঙ্গে একই স্থানে বসবাস করতে হবে। কোনো সন্তান তার পিতা বা মাতাকে বা উভয়কে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বৃদ্ধনিবাস বা অন্য কোথাও বা আলাদাভাবে বসবাস করতে বাধ্য করতে পারবে না। প্রত্যেক সন্তানকে তার পিতামাতার স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজ-খবর রাখতে হবে। প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা ও পরিচর্চা করবে। তারা পৃথকভাবে বসবাস করলে সন্তানদের নিয়মিত সাক্ষাৎ করতে হবে। এ-সংক্রান্ত অপরাধের জন্য এক লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে সর্বোচ্চ তিন মাসের জেলের বিধান রাখা হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আইন করে প্রবীণদের প্রতি সব বঞ্চনা, অবহেলা ও বৈষম্য দূর করা কি সম্ভব? ভালোবাসা, শ্রদ্ধাবোধ, কর্তব্যবোধ আইন পাস করে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন নৈতিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তন।
মানুষের গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ায় প্রবীণদের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশে প্রবীণ জনগোষ্ঠী ছিল ১৯৯০ সালে ৪০ লাখ ৯০ হাজার। এরপর ১৯৯১ সালে দাঁড়ায় ৬০ লাখে। এখন ১ কোটি ২৫ লাখের বেশি। ২০২৫ সালে এ সংখ্যা ১ কোটি ৮০ লাখ হবে প্রায়। ২০২৬ সালে এ সংখ্যা হবে এখনকার ৭ ভাগ বেড়ে ১০ ভাগে; অথচ ১৯৭৫ সালে সারাবিশ্বে প্রবীণের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩৫ কোটি। ক্রমবর্ধমান প্রবীণ জনগোষ্ঠীর অধিকারের ভিত্তিতে স্বার্থ সংরক্ষণ করতে হলে শিশু ও কিশোর বয়সে সন্তান-সন্তানাদিকে সততা, নৈতিকতা, ধর্মীয় ও মূল্যবোধের শিক্ষা দিতে হবে। সবাইকে মনে রাখতে হবে, আজকের নবীন ভবিষ্যতের প্রবীণ। বৃদ্ধাশ্রম নয়, পরিবারই হোক বাবা-মায়ের নিরাপদ আবাস। ডিজিটাল যুগের ইট-পাথরের পরিবেশেও অটুট থাকুক মিহি সুতায় বাঁধা পরিবারের সেই স্নেহ-ভালোবাসার বন্ধন, শ্রদ্ধা ও মর্যাদা।

No comments:

Post a Comment