নারীর
সমঅধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতার মাধ্যমে নারীর
ক্ষমতায়নের জন্য সারাবিশ্বই এখন সোচ্চার। এর জন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক
সংগঠন যেমন, WID (Women In Development), GAD (Gender And Development), UN
Women-এর উদ্যোগে (He for She campaign) সহ বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠন কাজ
করে যাচ্ছে। প্রতিবছর মার্চ মাসের ৮ তারিখ আন্তর্জাতিক নারী দিবস (আদি নাম
আন্তর্জাতিক কর্মজীবী নারী দিবস) হিসেবে পালিত হয়। অন্যান্য দেশের ন্যায়
আমাদের দেশেও দিবসটি নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে পালিত হয়েছে। এ বছর
আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘নারীর ক্ষমতায়ন, মানবতার উন্নয়ন’।
নারীর সমঅধিকার ও মর্যাদার ভিত্তিতে যে নারীর ক্ষমতায়ন আজও প্রতিষ্ঠিত
হয়নি প্রতিপাদ্য বিষয়ে তা স্পষ্ট হয়েছে। নারী সৃষ্টির আদিকাল থেকেই পুরুষের
নিদারুণ স্বার্থপরতা ও আধিপত্যকামী মানসিকতার শিকার। পরিবার, সমাজ ও
রাষ্ট্রে নারী সমঅধিকার ও প্রাপ্য মর্যাদা থেকে বঞ্চিত। উনবিংশ শতকে বাঙালি
নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন সমাজজীবনে সবক্ষেত্রে
নারীদের পশ্চাত্পদতার উদাহরণ দিতে গিয়ে বলেছেন, স্বামী যখন পৃথিবী হইতে
সূর্য ও নক্ষত্রের দূরত্ব মাপেন, স্ত্রী তখন একটা বালিশের ওয়াড়ের দৈর্ঘ
প্রস্থ (সেলাই করার জন্য) মাপেন! স্বামী যখন কল্পনা-সাহায্যে সুদূর আকাশে
গ্রহ-নক্ষত্রমালা-বেষ্টিত সৌরজগতে বিচরণ করেন, সূর্যমণ্ডলের ঘনফল তুলাদণ্ডে
ওজন করেন এবং ধূমকেতুর গতি নির্ণয় করেন, স্ত্রী তখন রন্ধনশালায় বিচরণ
করেন, চাউল-ডাউল ওজন করেন এবং রাঁধুনির গতি নির্ণয় করেন। বিশ্বে নারীদের
এখন আর সেই আগের অবস্থা নেই। মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিরও অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন
হয়েছে। একই সাথে নারীরাও এখন নিজেদের অধিকারের বিষয়ে অনেক বেশি সচেতন। অনেক
বেশি সোচ্চার। তারা এখন নিজেদের যোগ্যতা দিয়ে অনেকদূর এগিয়ে গেছে।
বাংলাদেশি নারীরাও এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। দেশের অর্থনীতিতে নারীরা
গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে যাচ্ছে। দেশের পোশাক শিল্পে নিয়োজিত অধিকাংশ
শ্রমিক নারী। এ ছাড়া কৃষিক্ষেত্রেও নারীদের ভ‚মিকা গুরুত্বপূর্ণ। পুরুষের
সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নারীরা দেশের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। নারীর
ক্ষমতায়নে বিশ্বে অন্যান্য দেশের তুলনায় আমরা যে একধাপ এগিয়ে আছি তার
সবচেয়ে বড় প্রমাণ- আমাদের দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, সংসদের বিরোধীদলীয়
নেত্রী, সংসদের বাইরে বিরোধীদলীয় নেত্রী, সংসদের স্পিকারসহ গুরুত্বপূর্ণ
মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নারী অধিষ্ঠিত। এ ছাড়াও রাষ্ট্রের বিভিন্ন
গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীর অংশগ্রহণ তো রয়েছেই। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে নারীর
অবদান আজ অনস্বীকার্য। কিন্তু এ সত্তে¡ও নারী তাদের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা ও
মর্যাদা থেকে বঞ্চিত! যৌতুক প্রথা, বাল্যবিবাহ, বহু বিবাহ, ধর্মীয়
কুসংস্কার, পারিবারিক জীবনে পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের আধিপত্য। সমাজে
বিদ্যমান মান্ধাতা আমলের প্রথা, কুসংস্কার, ইভটিজিং নামক সামাজিক ব্যাধি
ইত্যাদি নারীর সমঅধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বড় বাধা। অন্যান্য
দেশের তুলনায় বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে নারীর
অংশগ্রহণ বেড়েছে এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। কিন্তু নারী নির্যাতন ও
বঞ্চনা থেমে নেই। দুঃখজনক হলেও সত্য নারীরা এখনও পরিবারে, সমাজে ও রাষ্ট্রে
শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক ও যৌন নির্যাতনসহ প্রতিনিয়ত বিভিন্ন
নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের দেয়া প্রাপ্ত তথ্যমতে,
দেশে গত ফেব্রুয়ারি মাসে মোট ৩৩৮ জন নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর
মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে মোট ৬৩টি। গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ১২ জন, ধর্ষণের
পর হত্যা করা হয়েছে ৮ জনকে। ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ১১ জন নারীকে।
এসিডদগ্ধের শিকার হয়েছেন ৩ জন নারী। অগ্নিদগ্ধের ঘটনা ঘটেছে ৪ জন নারীর
বেলায়। অপহরণ করা হয়েছে ৭ জন নারীকে। ৫ জন নারী ও শিশুকে পাচার করা হয়েছে।
নির্যাতনে হত্যা করা হয়েছে ৬৩ জন নারী ও শিশুকে। যৌতুকের কারণে হত্যা করা
হয়েছে ১৬ জনকে। এছাড়া ৪ জন গৃহপরিচারিকা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
উত্ত্যক্ত করা হয়েছে ৩২ জন নারী-কিশোরীকে। উত্ত্যক্তের কারণে আত্মহত্যা
করেছে ১ জন নারী। ধর্মের দোহাই দিয়ে ফতোয়ার শিকার হয়েছেন ১ জন নারী। আর
নানা বঞ্চনায় পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে বিভিন্ন নির্যাতনের কারণে ২৯ জন নারী
আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন। জেন্ডার সমতার বিষয়টি যে আজও দেশে
পুরোপুরিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি এবং নারী যে প্রতিনিয়ত সহিংসতা শিকার হচ্ছে
এসব তথ্য সেটাই প্রমাণ করে। সত্যিকারের কাংক্ষিত উন্নয়নের জন্য নারীর
সমঅধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন অবশ্যই প্রতিষ্ঠিত
করতে হবে। বন্ধ করতে হবে নারীর প্রতি সকল ধরনের সহিংসতা। নারীরাও সমাজের
অংশ এবং আমাদের সার্বিক উন্নয়নের অংশীদার এই বোধ সবার মাঝে জাগ্রত করতে
হবে। দেশের বৃহত একটা অংশ (নারী) পিছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব না।
তাই আধিপত্যকামী দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার করে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে নারীর
অবদানকে স্বীকৃতি দিতে হবে ।
|
A platform where you will get analytical articles on contemporary issues of national and international including politics, economics as well the social changes.
Saturday, 2 January 2016
নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠা
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment