Wednesday, 30 December 2015

মেধাই হোক ভর্তির একমাত্র মানদণ্ড

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকার অদূরে অপরূপ নৈসর্গিক পরিবেশের মাঝে অবস্থিত দেশের একমাত্র আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। মানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষা অর্জনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে জাবি দেশের অধিকাংশ মেধাবী শিক্ষার্থীর পছন্দের তালিকায় প্রথমদিকেই থাকে। মেধাবীদের অনেকেই জাবির শিক্ষার্থী হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। যে সকল শিক্ষার্থী  স্বল্প আসনের বিপরীতে তীব্র প্রতিযোগিতা
করে বিজয়ী হয় তাদের এ স্বপ্ন পূরণ হয়। কিন্তু যারা প্রতিযোগিতায় পরাজিত হয় তাদের লালিত স্বপ্ন অপূর্ণই থেকে যায়। তবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে  সাধারণ শিক্ষার্থীদের তুলনায় পোষ্য শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন পূরণের পথ অনেক সহজ। এখানে একজন পোষ্য (শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীর সন্তান,ভাই-বোন এবং স্বামী-স্ত্রী) শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেন। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচলিত অন্যান্য কোটার আসন সংখ্যা নির্দিষ্ট থাকলেও পোষ্য কোটার আসন নির্দিষ্ট নয়। অর্থাত্ যত জন পোষ্য উত্তীর্ণ হবে তত জনই ভর্তির সুযোগ পাবে। কিন্তু দেখেছি প্রতিবছরই পোষ্যদের একটা বৃহত্ অংশ ভর্তি পরীক্ষায় পাসই করে না । তখন অকৃতকার্য ঐসব পোষ্যর বিশ্ববিদ্যালয়ে  ভর্তির দাবিতে শুরু হয় আন্দোলন। আন্দোলনের অজুহাতে প্রায় প্রতিবছরই প্রশাসন অকৃতকার্য পোষ্যদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করে। অনুত্তীর্ণ পোষ্যদের ভর্তির জন্য অতিরিক্ত নম্বর দেয়ার ইতিহাসও আছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের। ভর্তি পরীক্ষায় পোষ্যরা উত্তীর্ণ না হয়েও এরা তাদের পছন্দমত বিভাগে ভর্তি হয়।

গতবছর এসব অনৈতিক সুবিধার বিরুদ্ধে আমরা সচেতন শিক্ষার্থীর ব্যানারে আন্দোলন করেছিলাম। সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের চাপে এবং  মিডিয়ার সমালোচনার মুখে প্রশাসন গতবছর অনুত্তীর্ণ পৌষ্যদের ভর্তি করা থেকে বিরত থাকে। কিন্তু এ বছর পোষ্যদের ভর্তির জন্য প্রশাসন নতুন পদ্ধতির আশ্রয় নিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবার চলতি  শিক্ষাবর্ষে (২০১৫-১৬) স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষায়  উত্তীর্ণ হওয়ার নম্বর শতকরা ৩৫ থেকে কমিয়ে ৩৩ নম্বর নির্ধারিত করেছে। এরফলে এ বছর ৮০ নম্বরের ভর্তি পরীক্ষায় ২৬ দশমিক ৪ পেলেই একজন পোষ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাবেন। বলা হচ্ছে, নির্ধারিত পাস নম্বর ভর্তিচ্ছু সকল শিক্ষার্থীর জন্য প্রযোজ্য। কিন্তু এর সুবিধাভোগী হবে পোষ্যরাই। কারণ পোষ্যরা উত্তীর্ণ হলেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে। কিন্তু  প্রতিযোগিতামূলক এ পরীক্ষায় সাধারণ একজন শিক্ষার্থী শুধু পাস করে ভর্তি হতে পারে না। সাধারণ একজন শিক্ষার্থীকে পাস করার পাশাপাশি সর্বোচ্চ মার্কস পেয়ে তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্যদিয়ে নিজের আসনটি নিশ্চিত করতে হয়। সুতরাং এক্ষেত্রে পাস নম্বর তাদের জন্য কোনো গুরুত্ব বহন করে না। তাহলে বিশেষ একটি গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতে পাস নম্বর কমানো কতটুকু নৈতিক এবং যুক্তিযুক্ত?

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা কোটা, শারীরিক প্রতিবন্ধী কোটাসহ বিশ্ববিদ্যালয়ে সাত ধরনের কোটা প্রচলিত আছে। এর মধ্যে পোষ্য কোটা ব্যতীত অন্যান্য সকল কোটার আসন সংখ্যা নির্ধারিত। কিন্তু পোষ্য কোটার আসন সংখ্যা নির্ধারিত না। গতবছর আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা মুক্তিযোদ্ধা কোটাসহ অন্যান্য কোটার সাথে সামঞ্জস্যতা রেখে পোষ্য কোটার আসন সুনির্দিষ্ট করা এবং অনুত্তীর্ণ পোষ্যদের ভর্তি না করার দাবিতে প্রায় হাজার শিক্ষার্থীর স্বাক্ষর সম্বলিত একটি স্মারকলিপি দিয়ে প্রশাসনকে দৃষ্টি আর্কষণ করেছিলাম। প্রশাসন গতবছর অনুত্তীর্ণ পোষ্যদের ভর্তি করেনি সত্য। তবে আজও ভর্তির ক্ষেত্রে পোষ্যদের আসন সংখ্যা নির্ধারিত করেনি। প্রতিবছরই প্রশাসন অনুত্তীর্ণ পোষ্যদের বিশেষ সুবিধা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করে। এরপর  পড়াশুনা শেষ করে এরাই আবার বিশেষ কোটায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পদে আসীন হয়। এভাবে চলতে থাকলে জাবি যে একসময় দেশের একটি পারিবারিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হবে এ আশঙ্কা করাই যায়।

সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত অবহেলিত, অসহায় ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা প্রদান করার বিধান হয়েছে। কিন্তু জাবিতে যে সকল পোষ্যর ভর্তির ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা দেয়া হয় এরা কি সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত, এরা কি অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর আওতাভুক্ত? বিশ্ববিদ্যালয়ের সুন্দর ও শিক্ষাবান্ধব একটি পরিবেশের মধ্যে এরা বড় হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেই অল্প বেতনে এরা স্কুল-কলেজে পড়াশুনার সুযোগ পাচ্ছে। চিকিত্সার জন্য ক্যাম্পাসের ফ্রী মেডিক্যাল সুবিধা রয়েছে। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত্ সুবিধা পাচ্ছে। যাতায়াতের জন্য ক্যাম্পাসের পরিবহন সুবিধা পাচ্ছে। এতসব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে একটা শিক্ষাবান্ধব পরিবেশে বড় হয়েও যারা ভর্তি পরীক্ষায় ন্যূনতম পাস নম্বরও পায় না তাদের বিশেষ সুবিধা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করার আদৌ কোনো যৌক্তিকতা আছে বলে মনে হয় না। দিনমজুরের সন্তান যেখানে অর্ধাহারে-অনাহারে পড়াশুনা করে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে মেধা দিয়ে ভর্তি হচ্ছে সেখানে পোষ্যদের বিশেষ সুবিধা দিয়ে ভর্তি করতে হবে কেন? পোষ্যদের বিশেষ সুবিধা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করা কেবল অযৌক্তিকই নয়, এটা অন্যায়ও বটে। তাই মেধাকেই সবার আগে মূল্যায়ন করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হলেও রাষ্ট্রের কাছে এবং রাষ্ট্রের জনগণের কাছে এর দায়বদ্ধতা আছে। মুক্তচিন্তার জায়গায় অবিচার, বৈষম্য কোনোভাবেই কাম্য নয়। সবার জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা, অধিকার নিশ্চিত করতে হবে ।

No comments:

Post a Comment