সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের জন্য সর্বোচ্চ ৮০ হাজার ও
সর্বনিম্ন ৮ হাজার ২০০ টাকা মূল বেতন ধরে নতুন বেতন কাঠামো সুপারিশ করছে জাতীয় বেতন
ও চাকরি কমিশন। এই বেতন বৃদ্ধি ছাড়াও কমিশন সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য স্বাস্থ্য ও জীবন
বীমা বাধ্যতামূলক করা, পেনশনের হার বাড়ানো এবং কল্যাণ তহবিলের সংস্কার, বাড়ি নির্মাণ ও
গাড়ি কেনার জন্য অধিক সুবিধা সৃষ্টিসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার জন্য সুপারিশ করেছে সরকারের
কাছে। এছাড়া প্রস্তাবিত বেতন কাঠামোতে (স্কেল) ২০টি স্তরের (গ্রেডের) পরিবর্তে ১৬টি
স্তর রাখা হয়েছে এবং আগের সরকারি বেতন স্কেলগুলো চার বছর মেয়াদের জন্য করা হলেও নতুন
এই স্কেল হবে ছয় বছরের জন্য। এ গ্রেডে আগের তুলনায় বেতন বৃদ্ধি পেয়েছে দ্বিগুণ।
অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী ২০১৫ সালের ১ জুলাই থেকে প্রায়
সাড়ে বারো লাখ সরকারি চাকরিজীবী নতুন এই কাঠামোতে বেতন পাবেন। সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের
জন্য এটা সুসংবাদ এবং বিষয়টা যৌক্তিকও বটে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেতন-বোনাস ও পদোন্নতি
নির্ধারণ করা খুবই জরুরি। এতে মানুষের কর্মস্পৃহা বৃদ্ধি পায়। সীমিত সুযোগ-সুবিধা ও
অল্প বেতনের কারণে আমাদের দেশের মেধাবীদের অধিকাংশই সরকারি চাকরির প্রতি অনীহা প্রকাশ
করে। মেধাবীদের একটা বড় অংশ বেসরকারি চাকরি করে অথবা বিদেশে পাড়ি জমায়। ফলে দেশ ও জাতি
মেধাবীদের সেবা থেকে বঞ্চিত হয়। কিন্তু নতুন বেতন কাঠামোর ফলে নতুনরা সরকারি চাকরিতে
আকৃষ্ট হবে। সার্বিকভাবে বেতন বৃদ্ধি সৎ,
দক্ষ ও মেধাবীদের সরকারি চাকরিতে ধরে রাখতে
যে সাহায্য করবে তা বলাই যায়। তবে নতুন পে-স্কেল সরকারি চাকরিজীবীদের জীবনে কতটুকু
কল্যাণ বয়ে আনবে তা জানি না। তবে স্বল্প আয়ের সাধারণ মানুষের জন্য হবে দুঃসংবাদ, যদি বেতন বৃদ্ধির
প্রভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দাম নতুন করে বৃদ্ধি পায়। কারণ বেতন বৃদ্ধির ফলে
সরকারি চাকরিজীবীদের আয় বৃদ্ধি পেলেও সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে না।
এমনিতেই দেশে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম অল্প আয়ের সাধারণ
মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। এর পর যদি নতুন করে মূল্যস্ফীতি ঘটে, তাহলে সাধারণ মানুষের
জন্য ডাল-ভাত খেয়ে বেঁচে থাকাই দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে। অতীতে আমরা দেখেছি যখনই নতুন পে-স্কেল
বাস্তবায়ন করা হয়েছে তখনই নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। বেতন বৃদ্ধির কথা শুনলেই
আমাদের দেশে বাড়িভাড়া থেকে শুরু করে সব নিত্য-প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম জ্যামিতিক হারে
বৃদ্ধি পেতে থাকে। নতুন পে-স্কেলের সুযোগ কাজে লাগিয়ে যদি বাজারে অন্যান্য প্রয়োজনীয়
জিনিসসহ নিত্যপণ্যের দাম বাড়ে, তাহলে স্বল্প আয়ের মানুষের যেমন কষ্ট বাড়বে, তেমনি বেতন বৃদ্ধির
সুফল থেকে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা বঞ্চিত হবেন। তাদের জীবন-মানে কোনো ইতিবাচক
পরিবর্তন আসবে না। সুতরাং নতুন বেতন কাঠামো অর্থনীতিতে যাতে উচ্চমূল্যস্ফীতির সম্ভাবনা
তৈরি করতে না পারে, সরকারকে সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে। সরকারি চাকরিতে বেতন বৃদ্ধির
ফলে দেশের পোশাক শিল্পসহ বেসরকারি ব্যাংক,
বীমা ও কলকারখানায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের
বেতন বৃদ্ধির দাবি সামনে চলে আসতে পারে। শ্রমিকরা বেতন বৃদ্ধির দাবিতে জোটবদ্ধ হতে
পারেন। এক্ষেত্রে তারা হয়তো আন্দোলন-বিক্ষোভের পথও বেছে নিতে পারেন। ইতিমধ্যে নতুন
বেতন কাঠামোতে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন স্তরে বেতন বৈষম্যের অভিযোগ এনে দ্রুত নিরসনসহ
পাঁচ দফা আন্দোলনে নেমেছে বাংলাদেশ সরকারি কর্মচারী সমন্বয় পরিষদ। দাবি মানা না হলে
বৃহৎ আন্দোলন গড়ে তোলার হুমকিও দিয়েছেন তারা।
সরকারকে এ বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখতে হবে। পাশাপাশি জনগণের
জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সেবার মান উন্নত ও নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের দেশের সরকারি
খাতগুলো সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত। অধিকাংশ সরকারি অফিসে ঘুষ ছাড়া যেন কোনো কাজই
হয় না! প্রতিটি পদে পদে ঘুষ! ঘুষ, দুর্নীতি পরিত্যাগ করে সরকারি চাকরিজীবীদের দায়িত্ব-কর্তব্য
পালনে আন্তরিকতা ও সততার পরিচয় দিতে হবে। তাদের মাথায় রাখতে হবে, বর্ধিত এই বেতনের
জোগানদাতা এ দেশের জনগণ। সুতরাং জনগণের সেবা প্রদান করা তাদের প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য।
তারপরও বেতন বাড়ানোর পর যদি কেউ দুর্নীতি করেন,
তাহলে আইনের মাধ্যমে তাদের কঠোর শাস্তি
নিশ্চিত করতে হবে।
উচ্চহারে বেতন আর ঘুষ পাশাপাশি চলতে পারে না। সর্বোপরি বেতন
বৃদ্ধির ফলে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ যাতে না বাড়ে, সেজন্য সরকারকে মজুদ ও জোগান পরিস্থিতি
স্বাভাবিক রাখতে হবে। বাজারের ওপর সরকারের নজরদারি বাড়াতে হবে। পে-স্কেলের সুযোগে যেন
অসাধু ব্যবসায়ীর দল কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি করতে না পারে সেটি
সরকারের জন্য এখন একটা বড় চ্যালেঞ্জ। সময়ের সাথে পরিস্থিতি অনুযায়ী বেতন বৃদ্ধি আশার
কথা। নতুন পে-স্কেল কার্যকর হলে সীমিত আয়ের সাধারণ জনগণ যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এবং
সরকারি চাকরিজীবীগণ যেন লাভবান হয় এমনই আশা করি। কাজের ক্ষেত্রেও এই বেতন বৃদ্ধির সুফল
প্রতিফলিত হোক, বাংলাদেশ উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাক এটাই সকলের প্রত্যাশা।
No comments:
Post a Comment