জাতিসংঘের ৭০তম
সাধারণ অধিবেশনে অংশগ্রহণ শেষে দেশের জন্য বিরল সম্মান বয়ে এনে প্রায় এক সপ্তাহ পর
দেশে ফিরেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। সফরকালীন তিনি জাতিসংঘ সদর দপ্তরে
শান্তিরক্ষাবিষয়ক সম্মেলনে, টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নবিষয়ক আলোচনা সভায়, দক্ষিণ-দক্ষিণ
সহযোগিতা বিষয়ে গোলটেবিল আলোচনায়, লিঙ্গসমতা ও নারীর ক্ষমতায়ন
নিয়ে বিশ্বনেতাদের এক বৈঠকে এবং এমডিজি ও এসডিজিবিষয়ক এক উচ্চপর্যায়ের আলোচনায়
বক্তব্য রেখেছেন। এ সময় তিনি জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে, চীনা প্রেসিডেন্ট
শি জিনপিং এবং নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুটের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকেও
অংশ নিয়েছেন। এ বছর জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় ‘বিচক্ষণ
নেতৃত্বের’ স্বীকৃতি হিসেবে জাতিসংঘের ‘চ্যাম্পিয়নস অব দি আর্থ’ এবং
তথ্যপ্রযুক্তিতে অগ্রগতির স্বীকৃতি হিসেবে আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ সংস্থা
(আইটিইউ) বাংলাদেশকে ‘আইসিটি টেকসই উন্নয়ন পুরস্কার’-এ ভূষিত করেছে। আমাদের জন্য
এটা নিঃসন্দেহে গর্বের ও মর্যাদার। দেশের জন্য বিরল এ সম্মান বয়ে আনার জন্য মাননীয়
প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানাই।
বিশ্বের বুকে
যখনই বাংলাদেশের নাম ইতিবাচক কোনো কারণে উচ্চারিত হয়, তখন সত্যিই গর্বে
বুক ফুলে ওঠে। খুশিতে ও অহংকারে চোখে জল চলে আসে। কিন্তু যখন গণমাধ্যমে দেখি, তাজরীনে আগুনে
পুড়ে শ্রমিক দগ্ধ হয়েছে, আইন অমান্য করে অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত রানা প্লাজা ধসে হাজারের
বেশি শ্রমিকের করুণ মৃত্যু হয়েছে, সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়স্থল মায়ের
গর্ভে সুরাইয়া গুলিবিদ্ধ হয়েছে, টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে ছেলের
সামনে মা ধর্ষণের শিকার হয়েছে এবং ধর্ষকের বিচার চেয়ে এলাকাবাসী পুলিশের গুলিতে
প্রাণ হারিয়েছে, প্রতিহিংসার শিকার হয়ে ত্বকী, রাজন ও রাকিবের মতো শিশুরা
অকালে প্রাণ হারাচ্ছে, নিরপরাধ দর্জি দোকানি বিশ্বজিৎকে কেউ দিনদুপুরে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে
হত্যা করেছে, সাংসদের ছোড়া গুলিতে রক্তাক্ত হয়ে কোনো নিরপরাধ শিশু হাসপাতালের
বেডে কাতরাচ্ছে, রাষ্ট্রের ব্যর্থতার কারণে আমাদের দেশে এসে বিদেশি কোনো নাগরিক খুন
হয়েছেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী লাঠিয়াল বাহিনীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে, দেশে ক্রমাগত
খুন-গুম-অপহরণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, তখন সত্যিই খুব হতাশ হই। দেশের
সব অর্জন যেন নিমেষেই চোখের সামনে ম্লান হয়ে যায়। তখন অতি দুঃখে, লজ্জায় ও ক্ষোভে
প্রিয় কবি নবারুণ ভট্টাচার্যের মতো বলতে ইচ্ছা হয়, ‘এই মৃত্যু
উপত্যকা আমার দেশ না।’ তবে এসব ঘটনার জন্য রাষ্ট্র যে এককভাবে দায়ী তা কিন্তু নয়; আমাদের নৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয়
অবক্ষয়ও অনেকাংশে দায়ী। অপ্রত্যাশিত ও অনাকাঙ্ক্ষিত এসব ঘটনা ঘটার পর মিডিয়া কয়েক
দিন ফলোআপ করে, মানুষ কিছুদিনের জন্য সোচ্চার হয়ে ওঠে। কিছুদিন পর যেন সব স্বাভাবিক!
আবার নতুন অপরাধ সংঘটিত হয়। এভাবেই চলছে স্বদেশ।
বর্তমানে
মিডিয়াপাড়ার হট কেক বিদেশি নাগরিক হত্যা। ইতালির নাগরিক চেসারে তাভেলা হত্যার রেশ
কাটতে না কাটতেই রংপুরে দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হলেন জাপানের নাগরিক হোশি কুনিও।
কয়েক দিনের ব্যবধানে প্রায় একই কায়দায় এ দুজন বিদেশি নাগরিক খুনের শিকার হয়েছেন।
মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) টুইট করে এ হত্যাকাণ্ডের দায়
স্বীকার করেছে। একই সঙ্গে সন্ত্রাসী সংগঠনটি এ ধরনের আরো হামলার হুমকি দিয়েছে।
সন্ত্রাসী সংগঠন থেকে এ ধরনের হুমকি আমাদের জন্য খুবই উদ্বেগজনক। এরই মধ্যে
যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অধিকাংশ মোড়ল রাষ্ট্র বিষয়টি গুরুত্বসহকারে খতিয়ে দেখতে
শুরু করেছে। যদিও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে জঙ্গি তৎপরতার বিষয়টি উড়িয়ে দেওয়া
হচ্ছে।
ইতালির নাগরিক
তাভেলা হত্যার ঘটনাটি অনেকের কাছে বিচ্ছিন্ন বলে মনে হলেও সপ্তাহ পার না হতে প্রায়
একই কায়দায় জাপানের নাগরিক হোশি কুনিও হত্যাকাণ্ড জনমনে নানা প্রশ্নের জন্ম
দিয়েছে। এ অবস্থায় প্রশ্ন হতেই পারে, আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ কি
তাহলে দিন দিন জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হচ্ছে?
রাষ্ট্রের পক্ষ
থেকে জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের তৎপরতার বিষয়টি অগ্রাহ্য করা হলেও সন্ত্রাসী সংগঠন
আইএসের হুমকি এবং পরপর প্রায় একই কায়দায় দুজন বিদেশি নাগরিক হত্যার ঘটনা আমাদের
স্বাধীন দেশের সম্মান, নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। দেশের আইন-শৃঙ্খলা
বাহিনীকে অতিদ্রুত এ হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত রহস্য খুঁজে বের করতে হবে। জড়িতদের
বিচারের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করত হবে। বিশ্বের কাছে প্রমাণ করতে হবে, শহীদের রক্তের
বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশ কোনো জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের রাষ্ট্র নয়।
স্বাধীনতার পর
যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে পুনর্গঠনের জন্য বিশ্বের যেসব দেশ সহায়তা নিয়ে এগিয়ে
এসেছিল, জাপান তাদের মধ্যে অন্যতম। এ ছাড়া স্বাধীনতা প্রাপ্তির কয়েক
সপ্তাহের মধ্যেই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় জাপান। সুতরাং জাপান যে বাংলাদেশের
সত্যিকারের বন্ধুরাষ্ট্র, সে বিষয়ে সন্দেহ থাকার কথা নয়। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের
প্রধান দাতা দেশের ভূমিকা পালন করছে সূর্যোদয়ের দেশ জাপান। সুতরাং জাপানি নাগরিকের
হত্যার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় আনতে হবে, যাতে এ
হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে দুই দেশের সম্পর্কে চির না ধরে। হোশি কুনিও একজন সামান্য
আলু ব্যবসায়ী—এ ধরনের বক্তব্য সমস্যার সমাধান না করে বরং নতুন সংকটের সৃষ্টি
করবে। এরই মধ্যে বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়ে গেছে। বিশ্ব মিডিয়া
ফলাও করে নেতিবাচক এসব ঘটনা প্রচার করছে। বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশি নাগরিকরা
নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। কিছু দূতাবাস তাদের নাগরিকদের চলাচলের ওপর সতর্কতা জারি
করেছে। তৈরি পোশাকের কিছু ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে
বাংলাদেশ সফর বাতিল করেছেন। এমনকি আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যেও অনেক বিদেশি
বিনিয়োগকারী ব্যবসায়ী বাংলাদেশে আসবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন দেশের ব্যবসায়ীদের।
এই হত্যাকাণ্ড থেকে একটা বড় ধরনের হ-য-র-ল-ব অবস্থা সৃষ্টির আগেই সার্বিক
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। এ ছাড়া বাংলাদেশ শুধু বিদেশের মাটিতে ইমেজ সংকটেই
পড়বে না, দেশের অর্থনীতিও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
No comments:
Post a Comment