Wednesday, 30 December 2015

শিশু হত্যা বন্ধ করুন

সাম্প্রতিক সময়ে দেশে ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন গণমাধ্যমে শিশু অপহরণ, হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতনসহ এমন বিভিন্ন অপরাধমূলক ঘটনার সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। এসব ঘটনায় মানুষরূপী নরপশুদের পৈশাচিক ও বর্বরোচিত হামলায় একের পর এক অকালে ঝরে যাচ্ছে আমাদের জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার। নরপশুদের হিংস্রতা থেকে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র কেউ-ই তাদের রক্ষা করতে পারছে না! এসব লোমহর্ষক ঘটনা নতুন নয়। এগুলো বছরের পর বছর ধরে আমাদের সমাজে চলে আসছে। প্রচারমাধ্যমের অভাবে এগুলো আগে আমাদের অজানা থাকত। কিন্তু বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়ন ও মিডিয়ার কল্যাণে মুহূর্তের মধ্যেই ঘরে বসেই আমরা এসব ঘটনা জানতে পারি। গত মাসে সিলেটে চুরির অভিযোগে মো. সামিউল আলম ওরফে রাজন নামে এক কিশোরকে পিটিয়ে হত্যা করে মানুষরূপী কিছু জানোয়ার। নরঘাতকের দল ঠা-া মাথায় রাজনকে নির্যাতন করে হত্যা করে। তারপর হত্যাকা-ের সেই দৃশ্য ভিডিও করে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়। ঘাতকদের পৈশাচিকতায় যতটুকু না অবাক হয়েছি তার চেয়ে বেশি অবাক হয়েছি তাদের এমন দুঃসাহসে। নৃশংস এ ঘটনার বিচার দাবিতে ফুঁসে ওঠে দেশের বিবেকবান প্রতিটি মানুষ। স্থানীয় জনতা অপরাধীদের ধরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে সোপর্দ করে। এ ঘটনার বিচার শেষ না হতেই রাকিব নামে এক শিশু নির্যাতনের শিকার হয়। নির্যাতনের এক পর্যায়ে মোটরসাইকেলে হাওয়া দেয়ার যন্ত্রের নল রাকিবের মলদ্বার দিয়ে প্রবেশ করিয়ে বাতাস ছেড়ে দেয় মানুষরূপী কিছু জানোয়ার। ওই যন্ত্রের মাধ্যমে রাকিবের মলদ্বার দিয়ে প্রচ- বেগে হাওয়া প্রবেশ করানো যা সে এক পর্যায়ে মারাত্মক অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করে। কী বীভৎসতা! হায়রে মনুষ্যত্ব! শিশু রাকিবকে যে কায়দায় হত্যা করা হয়েছে তা সত্যিই অকল্পনীয়। ভাবলেই শরীরের পশম খাড়া হয়ে ওঠে। মানুষ হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতেও ঘৃণা হয়। মানুষ কিভাবে এতটা নিষ্ঠুর হতে পারে? এ ঘটনার রেশ না কাটতেই রবিউল নামের আরেক শিশু নির্মমতার শিকার হয়েছে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানতে পারলাম বরগুনার তালতলী থানার এক গ্রামে মাছ চুরির অভিযোগে ১১ বছর বয়সী এ শিশুটিকে তার এক প্রতিবেশী পিটিয়ে হত্যা করে পুকুরে লাশ ফেলে দিয়েছে সর্বশেষ মাদারীপুরে সুমাইয়া ও হ্যাপি নামে দুই স্কুলছাত্রী নির্যাতনের শিকার হয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিল। পরিবারের অভিযোগ, ধর্ষণের পর তাদের হত্যা করা হয়েছে। এমন পৈশাচিকতা ও নিষ্ঠুরতার মধ্যেই আমাদের বসবাস! মানবিক মূল্যবোধের এ কেমন অবক্ষয়! সভ্যযুগে এ কেমন অসভ্যতা! এমন অধঃপতিত ও অবক্ষয়যুক্ত সমাজ তো আমাদের কাম্য নয়। দিনদিন শিশুর প্রতি যে সহিংসতা এবং নির্মমতা বাড়ছে একথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে এখানে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে নির্যাতিত শিশুদের প্রায় সবাই-ই নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। যে বয়সে তাদের স্কুলে যাওয়ার কথা, বন্ধুদের সঙ্গে হই-হুল্লোড় করে সময় কাটানোর কথা সেই বয়সে রাজন, রাকিবের মতো শিশুরা জীবিকার প্রয়োজনে সবজি বিক্রি করে, গ্যারেজে কাজ করে। রাষ্ট্র এসব শিশুর মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে পারেনি। অবহেলা, বঞ্চনা, নির্যাতনের মধ্যেই এদের বেড়ে ওঠা। এই ব্যর্থতা শুধু রাষ্ট্রের নয়; আমার, আপনার অর্থাৎ আমাদের। সব অধিকার কেড়ে নিয়ে শেষ পর্যন্ত আমরা যেন ওদের বেঁচে থাকার অধিকার টুকুও কেড়ে নিচ্ছি! বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন অনুযায়ী খুন, ধর্ষণ ও অপহরণসহ নানাভাবে গত ছয় মাসে প্রায় তিন হাজার শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী গত ৬ মাসে ১৫৪ শিশুকে হত্যা করা হয়, ধর্ষিত হয়েছে ২৩০ শিশু। ১২৭ শিশু হয়েছে অপহরণের শিকার। অপহরণের পর হত্যা করা হয়েছে ২৩ শিশুকে। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে আরো ১৭ শিশুকে। প্রতিবেদন অনুযায়ী জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত হত্যা করা হয়েছে ৬৬ শিশুকে। অন্যদিকে পরের তিন মাসে হত্যার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৮ জনে। এভাবে জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার হয় ৯৬ জন, যা পরের তিন মাসে বেড়ে দাঁড়ায় ১৩৪। জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে অপহরণের শিকার হয় ৪১ শিশু, যা পরের তিন মাসে হয়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। কিন্তু মানবিক মূল্যবোধের কেন এমন অবক্ষয়? কেন এমন পৈশাচিকতা? কেন দিনদিন এসব অপ্রত্যাশিত ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে? বিচারহীনতার সংস্কৃতি, বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা, সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, সুশিক্ষার অভাব, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, প্রশাসনের ওপর রাজনৈতিক প্রভাবসহ বিভিন্ন কারণে শিশু অপহরণ, হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতনসহ নানাবিধ সন্ত্রাসী কর্মকা- দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আমরা সুন্দর একটি পৃথিবী উপহার দিতে পারছি না। আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। নিজেদের স্বার্থে হলেও আমাদের এই ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করতে হবে। আমাদের একটু আন্তরিকতা ও সচেতনতা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মতৎপরতা, দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিই দিতে পারে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি সুস্থ ও বাসযোগ্য বাংলাদেশের নিশ্চিয়তা। তাই আসুন কবি সুকান্তের মতো আমরাও অঙ্গীকার করি 'এ বিশ্বকে এ-শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।

No comments:

Post a Comment