Wednesday, 30 December 2015

সীমান্তে আবারও হত্যা, কথা রাখেনি বিএসএফ


সীমান্তে হত্যা ও নির্যাতন বন্ধের জন্য ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) সঙ্গে বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিবি) দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে। প্রতিবারই বিএসএফ বিজিবিকে সীমান্তে হত্যা ও নির্যাতন শূন্যে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এর কোন প্রতিফলন নেই। সীমান্তে বিএসএফের অমানবিক-ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ থেমে নেই! বরং দিন দিন যেন বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত ৩ ফেব্রুয়ারি দিনাজপুর জেলার বিরামপুর উপজেলার অচিন্তপুর সীমান্তে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিএসএফের গুলিতে নজরুল ইসলাম নামে এক বাংলাদেশি কৃষক নিহত এবং সাহাজুল নামে আরেকজন আহত হয়েছেন। অচিন্তপুর সীমান্ত পিলার নং ২৯৫-এর কাছে জমিতে ধানের চারা রোপণ করার সময় ভারতের ৯৬ বিএসএফের ঘুরছি ক্যাম্পের বিএসএফের সদস্যরা তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লে এ ঘটনা ঘটে। হত্যাকা- ঘটানোর পর নিহত নজরুল ইসলামের লাশ বিএসএফ টেনেহিঁচড়ে ভারতের অভ্যন্তরে তারকাঁটার বেড়ার কাছে নিয়ে গেছে।

কিছুদিন আগেও বেনাপোলের পুটখালী সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে ফারুক ও আলম নামে দুই বাংলাদেশি গরু ব্যবসায়ী নিহত হন। শুধু তাই নয়, আরেকটি উদ্বেগজনক সংবাদ হচ্ছে আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী সীমান্তে বিএসএফ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে নিরীহ গ্রামবাসীর ওপর হামলা চালায়। এ সময় বিএসএফের রাবার বুলেটে বালাটারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণীর এক ছাত্র আহত হয়। 

বিএসএফ সদস্যদের কেন এমন ঔদ্ধত্য-অমানবিক আচরণের উত্তর আমাদের জানা নাই। তবে তাদের এরূপ আচরণ আমাদের মর্মাহত করে। প্রতিবেশী বন্ধু রাষ্ট্র থেকে আমরা এরূপ আচরণ আশা করি না। সীমান্তে যেন জঙ্গি ও সন্ত্রাসী চক্র এবং অস্ত্র-মাদক ও মানব পাচারকারীরা ব্যবহার করতে না পারে, সে বিষয়ে উভয় দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করবে এটা খুবই স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে কোন অপরাধী যেন অন্যায় করে পার পেয়ে না যায়, সে ব্যাপারেও উভয় দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী সচেতন থাকবে। অন্যায়কারীর শাস্তি হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বিএসএফের গুলিতে বারবার বাংলাদেশি নিহতের ঘটনা কিংবা আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে বাংলাদেশে অভ্যন্তরে বিএসএফের প্রবেশ আমাদের কি বার্তা দেয়?

নিঃসন্দেহে বিএসএফের এরূপ ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ খুবই অপ্রত্যাশিত। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব মতে, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) হাতে গত বছর ৩৪ বাংলাদেশি হত্যার শিকার হয়েছেন। এ ৩৪ বাংলাদেশির মধ্যে বিএসএফের সরাসরি গুলিতে ১৭ জন এবং নির্যাতনের মাধ্যমে ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। আসকের মতে, ২০১৩ সালে বিএসএফের হাতে নিহত হয়েছে ৩৮ বাংলাদেশি। এর আগের বছর ২০১২ সালে নিহত হয়েছে ৩৬ জন। সীমান্তের কাঁটাতারের কাছেই কোনো বাংলাদেশি নাগরিক তাদের প্রয়োজনে গেলেই বিএসএফ হয় গুলি করে, না হয় তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে শারীরিক নির্যাতন করে। অজুহাত হিসেবে সর্বদাই চোরাচালানের বিষয়টা তুলে ধরার চেষ্টা করে।

প্রশ্ন হচ্ছে চোরাচালানের সঙ্গে কি শুধু বাংলাদেশি নাগরিকই জড়িত? বাস্তবতা কিন্তু ভিন্ন কথা বলে। সীমান্তে চোরাচালানের সঙ্গে দুই দেশের মানুষের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এমনকি অনেক বিএসএফ সদস্যের বিরুদ্ধেও এ অভিযোগ আছে বলে জানা যায়। তাহলে সীমান্তে কেন বারবার বাংলাদেশি জনগণ এ ধরনের নির্মম ও নৃশংস হত্যাকা-ের শিকার হবে? কোন বাংলাদেশি অবৈধভাবে ভারতের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে প্রবেশ করলে বিএসএফ তাদের আটক করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করতে পারে। প্রচলিত আইনে তাদের বিচার করতে পারে। কিন্তু গুলি বা নির্যাতন করে হত্যা করতে পারে না। কোন স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র কখনোই তার বেসামরিক নিরীহ নাগরিকদের এমন নির্বিচার হত্যা, নির্যাতন কিংবা অপহরণ মেনে নিতে পারে না। 

ভারত দীর্ঘদিন ধরে সমঝোতা চুক্তি ও প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করে বিনা উস্কানিতে একের পর এক সীমান্তে বেসামরিক নাগরিক হত্যা করছে। এসব হত্যাকা- ও নির্যাতন নিঃসন্দেহে আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। দুঃখজনক এসব হত্যাকা-ের সুষ্ঠু বিচারও হয় না। ফলশ্রুতিতে বেড়েই চলছে নির্যাতন ও হত্যাকা-ের মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কোন্নয়নে সীমান্তে হত্যা একটি অন্যতম বড় বাধা। ভারতের মতো একটি বৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কাছে প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে আমরা কখনোই এরূপ ব্যবহার আশা করি না। আশা করি বিএসএফের ঔদ্ধত্য-অমানবিক আচরণ বন্ধ হবে। প্রতিষ্ঠিত হবে দুই দেশের মধ্যে সত্যিকারের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক।

No comments:

Post a Comment