Tuesday, 27 September 2016

ক্রিকেটাধিপত্য ও নারী ফুটবলারের লাঞ্ছনা

বাংলাদেশে নিছক কোনো খেলা নয়, বরং মাঝে মধ্যে উৎসবের উপলক্ষ হয়ে আসে এক একটি ক্রিকেট সিরিজ। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আমাদের সাফল্য যেমন অনুপ্রাণিত হওয়ার মতো, তেমনি ক্রিকেট দলের সঙ্গে বাহারি তকমা যুক্ত হয়েছে টিম-টাইগার্স। তবে ছেলেদের ফুটবল এদেশের যখন ক্রমশ জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে, ঠিক তখনই সম্পূর্ণ স্রোতের বিপরীতে গিয়ে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশের মেয়েরা গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপ ফুটবলের চূড়ান্ত পর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে। বাছাই পর্বে চীনা তাইপেকে ৪-২ গোলে হারিয়েছে। ২০১৭ সালে থাইল্যান্ডে মূলপর্বের খেলা অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশ দলের এ সফলতায় দেশবাসী আবেগাপ্লুত। দেশের জনগণ তাদের অভিনন্দন জানাতে কৃপণতা করেনি। এমনকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য গৌরবের উপলক্ষ নিয়ে আসা এই মেয়েদের প্রশংসা করেছেন। বলতে গেলে পর পর কয়েকটি ম্যাচ জেতার পর বাংলার আকাশে-বাতাসে অনূর্ধ্ব-১৬ নারী ফুটবলারদের জয়ধ্বনি। কিন্তু সবার এই আবেগ যে ক্ষণস্থায়ী, নিছক লোক দেখানো, তা বুঝতে খুব বেশি দেরি করতে হয়নি ইতিহাস সৃষ্টিকারী নারী ফুটবলারদের।
বাংলাদেশের ফুটবল যেখানে সময়ের আবর্তে ব্রাত্য, ছেলেদের ফুটবলে একের পর এক পরাজয় যখন আমাদের থমকে দিয়েছে, তখন এই মেয়েরা বলতে গেলে আমাদের নিভে যেতে থাকা আশার প্রদীপ নতুন করে জ্বালিয়েছে। তবে এত বড় একটা অর্জনের পর কৃষ্ণা-মারিয়া-সানজিদাদের ঈদে বাড়ি যেতে লোকাল বাসের যাত্রী হতে হয়েছে। এ বাসের যাত্রী হয়ে যাত্রাপথে পদে পদে লাঞ্ছিত, অপমানিত ও অশ্লীল বাক্যের শিকার হন তারা। বাংলাদেশের একজন ক্রিকেটারকে নিয়ে যতটা চিন্তা করা হয়, তাদের নিরাপত্তা, সম্মান আর সামাজিক স্ট্যাটাস যতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, সেখানে পুরো দৈন্য দেখা গেছে এদের ক্ষেত্রে। বিশেষ করে পুরো টিমকে মাঝ রাস্তায় ছেড়ে দেয়া হয়। তাদের সঙ্গে ছিল না ফুটবল ফেডারেশনের কোনো কর্মকর্তা, এমনকি তাদের যাত্রা নির্বিঘ্ন করতেও বাংলাদেশে ফুটবল ফেডারেশন থেকে নেয়া হয়নি কোনো বিশেষ পদক্ষেপ।
এটা অনাকাঙ্খিত যে এত বড় অর্জনের পরেও ফুটবল ফেডারেশন থেকে তাদের প্রতি ঈপ্সিত সম্মানটুকু দেখানো হয়নি। ঈদের আগে পথে-ঘাটে যত রকমের দুর্ভোগ থাকে, সব ধরনের দুর্ভোগ, কটুবাক্য ও অপমান সহ্য করে বাড়ি পৌঁছেও তাদের অভিজ্ঞতা ভালো হয়নি। কলসিন্দুর গ্রামে ফুটবলার তাসলিমার বাবাকে পিটিয়েছেন এক স্কুলশিক্ষক। দেশের হয়ে খেলা কলসিন্দুরের সব মেয়েকে ঢাকার সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ না দিয়ে স্কুলের হয়ে খেলার আদেশ দিয়েছিলেন ওই শিক্ষক। কিন্তু মেয়েরা তার কথা শুনেনি। এ কারণেই নাকি প্রথমে তাসলিমাকে গালাগাল এবং পরে তার বাবাকে মারধর করা হয়! কিন্তু দেশের জন্য এত বড় সম্মান বয়ে আনার ঠিক পর পরই পদে পদে লাঞ্ছনা ও অপমান কি তাদের কাঙ্ক্ষিত ছিল? এই কি তাদের জন্য আমাদের উপহার? আর শুরুতে তাদের প্রতি দেশবাসীর যে উচ্ছসিত ভালোবাসা, তা এত দ্রুত উবে গেল? তাই ভোগান্তির শিকার এক ফুটবলার টিভি ক্যামেরার সামনে জানালেন তার যন্ত্রণার কথা ঠিক এভবেই, ‘সুন্দর একটা রেজাল্ট করলাম আমরা, বাংলাদেশের হয়ে খেললাম কিন্তু আজকে...খুব কষ্ট লাগছে। বাসের মধ্যে যাত্রীদের কাছে এভাবে অপমান, লাঞ্ছনা ও ভোগান্তির শিকার হতে হবে তা কখনই ভাবিনি।’
দেশের প্রেক্ষাপটে এ হতাশা শুধু একজন খেলোয়াড়ের নয়, এ হতাশা একজন নারীরও। পাবলিক বাসে, রাস্তায় চলার পথে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রায় প্রতিটি স্থানে নারীরা ইভ টিজিং থেকে শুরু করে নানা বঞ্চনার শিকার হন। তবে আপাতত মারিয়া-সানজিদাদের নারী হিসেবে নয়, খেলোয়াড় হিসেবে বিবেচনা করে কয়েকটি প্রশ্ন উত্থাপন করা যেতেই পারে। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, যেখানে আমাদের ক্রিকেটাররা ইচ্ছেখুশি নিজের গাড়ি হাঁকিয়ে বেড়ান, কেউ কেউ নিয়মিত হেলিকপ্টারে পর্যন্ত চড়েন, সেখানে দেশের জন্য এমন সম্মান বয়ে আনা মেয়েগুলো কেন লোকাল বাসের যাত্রী হয়ে ঈদ করতে বাড়ি যাবে? কেন পথিমধ্যে তাদের কটুবাক্য শুনতে হবে? কেন তাদের প্রতি কর্তৃপক্ষের এমন উদাসীনতা ও অবহেলা? তারা কি একটু বিশেষ সুযোগ-সুবিধা, নিরাপত্তা, সম্মান প্রত্যাশা করে না?
বাফুফের এমন নির্বোধ কর্মকাণ্ডে যারপরনাই বিরক্ত হয়েছি। অন্তত এজন্যই আর বলতে দ্বিধা নেই, দেশে একমাত্র ক্রিকেটার বাদে অন্য প্রায় সব খেলোয়াড় অবহেলিত। তাদের তেমন গুরুত্ব দেয়া হয় না। ক্রিকেটারদের মতো যদিও দেশের অন্য খেলোয়াড়রাও লাল-সবুজের পতাকা বহন করেন। দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনেন, বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। তার পরও এরা প্রায় সময়ই উপেক্ষিত।
আমাদের মানতেই হবে বিশ্বক্রিকেটে বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম এখন শক্ত অবস্থানে। এ অর্জন একদিনে হয়নি। এর পেছনে রয়েছে খেলোয়াড়দের কঠোর শ্রম, ত্যাগ ও নিষ্ঠা। আর দেশ ও দেশের জনগণের পৃষ্ঠপোষকতা। দেশে ক্রিকেটকে যে পরিমাণে সাপোর্ট দেয়া হয়, অন্য কোনো খেলায় তা দেয়া হয় না। দিনের পর দিন ক্রিকেটের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার মুখে অচ্ছুত-অবহেলিত হয়ে যাচ্ছে অন্য সব ধরনের খেলা। আমাদের জাতীয় খেলা কাবাডি থেকে শুরু করে ফুটবল, হকি, অ্যাথলেটিকস এগুলোয় কারো কোনো দৃষ্টিই যেন নেই। আমরা জানি, ক্রিকেট আজকের অবস্থানে আসতে কতটা পৃষ্ঠপোষকতা দিতে হয়েছে। তাই দেশের অন্যান্য খেলা যদি এমন পৃষ্ঠপোষকতা পেত তাহলে হয়তো আমরা সেখান থেকেও ভালো কিছু উপহার পেতাম।
বাংলাদেশের বিভিন্ন দৈনিক বাঙালি-রাশিয়ান মেয়ে মার্গারিটা মামুনকে নিয়ে মেতে আছে। কিন্তু এ মাতামাতির মধ্যে খোদ আমাদের দেশের মাটিতেই তার মতো আরো কয়েক ডজন ক্রীড়াবিদের জন্ম নেয়ার পথ রুদ্ধ করা হচ্ছে, সেদিকে কারো খেয়াল আছে কি? আমরা জানি, একমাত্র ক্রিকেটার বাদে বাকিরা কতটা অপর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার মধ্যে শুধু নিজ মেধা, দৈহিক সক্ষমতা ও যোগ্যতা দিয়ে জাতীয় পর্যায় থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক আসরে প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। তারা যেভাবে এই অপর্যাপ্ত সুবিধার মধ্যেও দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনেন তা-ইবা কম কিসে! সম্প্রতি অনুষ্ঠিত রিও অলিম্পিকে বাংলাদেশ থেকে সাতজন খেলোয়াড় অংশগ্রহণ করেছেন। এর মধ্যে একজন সাঁতারু মাহফিজুর রহমান সাগর। অলিম্পিক থেকে দেশে ফিরে বাড়ি যাওয়ার পথে ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন তিনি। গণমাধ্যমে এ সংবাদ প্রকাশ না হলেও ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে ঘটনাটি আমি জানি। এই হচ্ছে দেশের একজন খেলোয়াড়ের নিরাপত্তা অবস্থা! গত লন্ডন অলিম্পিকে এই মাহফিজুর রহমান সাগরই বাংলাদেশের পতাকা বহন করেছিলেন। খেলোয়াড়রা দেশের প্রতিনিধি। লাল-সবুজের পতাকা তারা বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেন। এসবের বিনিময়ে তারা আমাদের কাছে কিছু চান না। কিন্তু কৃতজ্ঞ জাতি হিসেবে আমরা তাদের প্রতি একটু সম্মান তো দেখাতে পারি। এটা আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। অথচ দেশের মাটিতে মারিয়া-সানজিদাদের অপমানিত হতে হয়। দেশসেরা সাঁতারু মাহফিজুর রহমান সাগর অলিম্পিক থেকে দেশে এসে বাড়ি ফেরার পথে ছিনতাইয়ের শিকার হন। বিষয়গুলো ভাবতেই লজ্জা লাগে। আমাদের মানসিক দৈন্য কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে! নিঃসন্দেহে এ দৈন্য হতাশার জন্ম দেয়। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন, যে দেশে গুণীর কদর নেই, সে দেশে গুণী জন্মাতে পারে না। আর অনাগত সময় এমনই এক ভয়াবহতারই ইঙ্গিত দিচ্ছে আমাদের। আগে থেকে সতর্ক না হলে বাংলাদেশে একমাত্র ক্রিকেট বাদে আর কোনো খেলাধুলায় কারো আগ্রহ থাকবে বলে মনে হয় না। তখন বিশ্বের সব দেশ অলিম্পিক থেকে মেডেলের পসরা নিয়ে ঘরে যাবে, আর দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে আমাদের অসহায়ত্বের প্রহর।
এই লেখাটি বণিক বার্তা পত্রিকায় ২৭/০৯/২০১৬ ইং প্রকাশিত।

Monday, 19 September 2016

রক্ত দিয়েই দৃঢ় হোক বন্ধন

শ্রাবণের পড়ন্ত বিকেলে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। নৈসর্গিক সৌন্দর্যের মাঝে এক শান্ত নীরবতা। এমন মন ভুলানো আবেশে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আড্ডাস্থল খ্যাত ট্রান্সপোর্ট চত্বরের পাশে লাল ইটের গাঁথুনিতে গড়া বাঁধন অফিসে কিছু শিক্ষার্থী আড্ডায় মশগুল। প্রতিদিনই পৃথিবীর বুকে সন্ধ্যা নামার আগে ওরা এখানে এসে মিলিত হয়। একে অন্যের সঙ্গে খোশগল্পে মেতে ওঠে। কিন্তু আড্ডা দেওয়া তাদের মূল উদ্দেশ্য নয়। সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে, বিবেকের তাড়নায়, বিপদগ্রস্ত মানুষকে সেবাদানের মানসিকতা নিয়ে বাঁধন অফিসে প্রতিদিনই এরা উপস্থিত হয়। আড্ডার মাঝখানে রুক্ষ চুলের জীর্ণ পোশাক পরিহিত এক ব্যক্তি হাজির। চোখেমুখে তাঁর দুশ্চিন্তায় স্পষ্ট ছাপ। তাঁর সহধর্মিণী হাসপাতালে শয্যাগত। আজ রাতেই স্ত্রীর অপারেশন হবে। এ জন্য দুই ব্যাগ ও নেগেটিভ রক্তের প্রয়োজন। কিন্তু কোথাও তিনি রক্ত খুঁজে পাচ্ছেন না। তাঁর আর্থিক সামর্থ্যও নেই কোন ব্লাড ব্যাংক থেকে রক্ত কিনবেন। জাবি বাঁধন অফিসে এসেছেন রক্তের সন্ধানে। প্রতিদিনই এমন অসংখ্য মানুষ রক্তের প্রয়োজনে ছুটে আসে এখানে। এটি শুধু জাবি বাঁধন শাখার প্রাত্যহিক চিত্র নয়। দেশের প্রতিটি বাঁধন কেন্দ্রে এমন অসংখ্য মানুষ প্রতিদিনই রক্তের প্রয়োজনে আসে এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বাঁধনকর্মীদের দ্বারা উপকৃত হয়।
স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের দ্বারা পরিচালিত স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের একটি সংগঠন ‘বাঁধন’। এটি সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক ও অরাজনৈতিক একটি স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক সংগঠন। এই সংগঠনের কর্মীরা স্বেচ্ছায় রক্তদানে উদ্বুদ্ধকরণের জন্য নবীন শিক্ষার্থীদের রক্তদানের উপকারিতা সম্পর্কে অবহিত করে। সচেতনতামূলক পোস্টারিংয়ের আয়োজন করে। প্রতিবছর রক্তদাতাদের জন্য ডোনার সংবর্ধনার আয়োজন করে। এসবের পাশাপাশি সংগঠনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বিভিন্ন সেবা প্রদান ও জনগণের মধ্যে অজ্ঞতা দূর করে নানাবিধ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে সুস্থ সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে তারা।
প্রায় ১৯ বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলে ‘বাঁধন’-এর জন্ম। বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ, পিজি হাসপাতাল ও বারডেমসহ বেশ কিছু চিকিৎসাকেন্দ্রের অবস্থান হওয়ায় প্রায় প্রতিদিনই জরুরি রক্তের প্রয়োজনে অনেকেই ছাত্রাবাসে রক্তের সন্ধান আসত। ছাত্রাবাসের গেটে এসে রক্তের প্রয়োজনে অনেকে কান্নাকাটি করত। কখনো রোগীর আত্মীয়স্বজন হল গেটে ‘রক্ত চাই’ শিরোনামে নোটিশ লাগিয়ে দিত। ভাগ্যগুণে অনেকে রোগীর জন্য প্রয়োজনীয় রক্ত পেত। অনেকে ব্যর্থ হয়ে হতাশ হয়ে ফিরে যেত। বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য ছাত্রছাত্রী পরিচিত/অপরিচিত অনেক রোগীর জন্য প্রায়ই স্বেচ্ছায় রক্তদান করত। কিন্তু এই রক্তদান সীমাবদ্ধ ছিল। কারণ বেশির ভাগ শিক্ষার্থী তখন নিজের রক্তের গ্রুপই জানত না। নিয়মিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর শিক্ষার্থীদের স্বেচ্ছায় রক্তদান কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত রাখার মতো কোনো কাঠামোগত সাংগঠনিক উদ্যোগও ছিল না। ঠিক সেই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যারয়ের কিছুসংখ্যক শিক্ষার্থী ব্যক্তিগত উদ্যোগে বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর তাগিদ অনুভব করে। ১৯৯৭ সালে শহীদুল্লাহ হলের একজন আবাসিক ছাত্র তাঁর বন্ধুদের কাছে স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের একটি সংগঠন খোলার প্রস্তাব রাখেন। মহৎ এ প্রস্তাবে সবাই রাজি হয়। হলের একটি কক্ষে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর সংগঠনটির একটি নাম চাওয়া হয় সবার কাছে। কয়েকটি প্রস্তাবিত নামের মধ্য থেকে একটি নাম ‘বন্ধন’ সবার পছন্দ হয়। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক ছাত্রদের একটি সংগঠনের নাম বন্ধন থাকায় বন্ধনের অপভ্রংশ করে ‘বাঁধন’ নামটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।
বেশির ভাগ শিক্ষার্থী তখন তাদের রক্তের গ্রুপ জানে না। এ অবস্থায় সংগঠনের সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বিনা মূল্যে রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা করার ব্যবস্থা করা হবে। তারিখ নির্ধারিত হয় ১৯৯৭ সালের ২৪ অক্টোবর। দিনটি ছিল শুক্রবার। বাঁধনের ইতিহাসে ওই দিনটিই সংগঠনের আত্মপ্রকাশের দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। বিনা মূল্যে রক্তের গ্রুপ নির্ণয়ের মাধ্যমে সংগঠনটির আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ ঘটে। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব হলে অভিন্ন পদ্ধতিতে সংগঠনটির কার্যক্রম শুরু হয়। বিস্তৃতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সবার মধ্যে বৃহত্তর সাংগঠনিক যোগাযোগের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলে ১৯৯৮ সালের ৩১ অক্টোবর শাহিদুল ইসলাম রিপনকে আহ্বায়ক করে কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটি গঠিত হয়। এ কমিটি কয়েকটি নতুন ইউনিট খোলাসহ গঠনতন্ত্র প্রণয়ন ও পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় কমিটি নির্বাচন সম্পন্ন করে এবং ১৯৯৯ সালের ১০ আগস্ট নতুন কমিটির কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করে। এরপর থেকে নিয়মিতভাবে প্রতিবছর বাঁধনের কেন্দ্রীয়, জোনাল ও ইউনিট পর্যায়ে প্রায় ১২০টি কমিটি প্রতিবছর নতুন করে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় গঠিত হয়ে আসছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্কালীন উপাচার্য অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী টিএসসিতে বাঁধনের কেন্দ্রীয় অফিস হিসেবে একটি কক্ষ প্রদান করেন। অরাজনৈতিক সামাজিক সংগঠন হিসেবে বাঁধন সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে ২০০১ সালের ৮ জুন রেজিস্ট্রেশন সনদ লাভ করে। বর্তমানে বাঁধন দেশের ১৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, ৩৬টি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজসহ মোট ৫১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ১০০টি ইউনিট ও ১৫টি পরিবারের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের স্বেচ্ছায় রক্তদানে উদ্বুদ্ধ করে যাচ্ছে।
বাঁধনের প্রতিষ্ঠাতা শাহিদুল ইসলাম রিপন বলেন, ‘আমাদের দেশে প্রতিবছর অসংখ্য রোগী রক্তের অভাবে মারা যায়। অসংখ্য রক্তদাতা থাকা সত্ত্বেও প্রয়োজনে সময়মতো রক্ত পাওয়া যায় না, ক্ষেত্রবিশেষে অসম্ভবও বটে। বাঁধন প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ অবস্থার অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানে রক্তের অভাবে কোনো অসহায় দুস্থ রোগীর জীবন প্রদীপ নিভে যায় না। আজ অসহায় দুস্থ মুমূর্ষু রোগীর রক্তের প্রয়োজনে বাঁধন একটি নির্ভরতার নাম।’
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. আজম বলেন, ‘বাঁধন আগামী ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় এর কার্যক্রম চালু করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। স্বেচ্ছায় রক্তদানে শরীরের কোনো ক্ষতি হয় না, এই বার্তাটি আমরা সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে চাই। জনমনে এ সচেতনতা সৃষ্টি করতে পারলেই আমাদের স্বপ্ন পূরণ হবে। শহীদের রক্ত দিয়ে অর্জিত এই মাতৃভূমির বুকে রক্তের অভাবে আর একটি মানুষেরও জীবনের বাতি যেন নিভে না যায়।’

Monday, 12 September 2016

কলসিন্দুরের নারী ফুটবলার ও আমাদের মানসিক দৈন্যতা।

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এএফসি অনুর্ধ্ব-১৬ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশের মেয়েরা গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যা​ম্পিয়নশিপ ফুটবলের চূড়ান্তপর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে। বাছাইপর্বে চীনা টাইপেকে ৪-২ গোলে হারিয়েছে। ২০১৭ সালে থাইল্যান্ডের মূল পর্বের খেলা অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশ দলের এই সফলতার দেশবাসী আবেগে আপ্লুত। দেশের জনগণ তাদের অভিনন্দন জানাতে কৃপণতা করেনি। বাংলার আকাশে বাতাসে  অনুর্ধ্ব-১৬ নারী ফুটবলারদের জয়ধ্বনি। কিন্তু বাঙালির এ আবেগ যে ক্ষণস্থায়ী, নিছক লোক দেখানো তা বুঝতে খুব বেশি দেরি করতে হয়নি ইতিহাস সৃষ্টকারী নারী ফুটবলারদের। মাত্র দু'দিনের ব্যবধানে বাঙালি তাদের প্রাপ্য বুঝিয়ে দিয়েছে! এত বড় একটা অর্জনের পর মারিয়া সানজিদাদের ঈদে বাড়ি যেতে লোকাল বাসের যাত্রী হতে হয়েছে। শুধু তাই নয়, যাত্রা পথে হতে হয়েছে লাঞ্ছিত, অপমানিত ও অশ্লীল বাক্যের শিকার। তাদের সাথে ছিল না ফুটবল ফেডারেশনের কোন কর্মকর্তা, এমনকি তাদের যাত্রা নির্বিঘ্ন করতে ফেডারেশন থেকে নেয়া হয়নি কোন পদক্ষেপ। ফেডারেশন থেকে যদি একটা মাইক্রোবাস ভাড়া করেও তাদের বাড়ি পাঠানোর উদ্যোগ নিতো, তাহলেও কিন্তু মেয়েগুলোর এভাবে পথে অপমানিত হতে হয় না। দুঃখজনক এত বড় অর্জনের পরেও ফুটবল ফেডারেশন থেকে তাদের প্রতি নূন্যতম ভদ্রতা দেখানো হয়নি। ঈদের আগে পথেঘাটে যত রকমের দুর্ভোগ থাকে সব ধরনের দুর্ভোগ, কটুবাক্য ও অপমান সহ্য করে বাড়ি পৌঁছেও তাদের অভিজ্ঞতা ভালো হয়নি। কলসিন্দুর গ্রামে ফুটবলার তাসলিমার বাবাকে পিটিয়েছে এক স্কুলশিক্ষক৷ দেশের হয়ে খেলা কলসিন্দুরের সব মেয়েকে ঢাকার সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ না দিয়ে স্কুলের হয়ে খেলার আদেশ দিয়েছিলেন ঐ স্কুলশিক্ষক৷ কিন্তু মেয়েরা তাঁর কথা শুনেনি। এ কারণেই নাকি প্রথমে মেয়েকে গালাগাল এবং তারপর তাঁর বাবাকে মারধর! পত্রিকায় পড়লাম স্কুল থেকেও নাকি তাদের বিতাড়িত করা হবে! দেশের জন্য এত বড় সম্মান বয়ে আনার পর প্রতিটি পদে পদে লাঞ্ছনা ও অপমান। এই হচ্ছে তাদের উপহার! তাদের প্রতি বাঙালির ভালোবাসা! "এত সুন্দর একটা রেজাল্ট করলাম আমরা, বাংলাদেশের হয়ে খেললাম কিন্তু আজকে.........খুব কষ্ট লাগছে।" বাসের মধ্যে যাত্রীদের কাছে অপমান, লাঞ্ছনা ও ভোগান্তির শিকার হয়ে টিভি ক্যামেরার সামনে কথাগুলো বলেছেন কলসিন্দুরের এক নারী ফুটবলার। দেশের প্রেক্ষাপটে এ হতাশা শুধু একজন খেলোয়ারের না, এ হতাশা একজন নারীর। পাবলিক বাসে, রাস্তায় চলার পথে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রায় প্রতিটি স্থানেই নারীরা ইভটিজিং এর শিকার হয়। অপমান ও লাঞ্ছনার শিকার হয়ে অনেকে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চিরবিদায় নিতে বাধ্য হয়। যাইহোক, এ বিষয়ে আলোচনায় যাবো না। আপাতত মারিয়া সানজিদাদের নারী হিসেবে না, খেলোয়ার হিসেবে বিবেচনা করে কয়েকটি প্রশ্ন করতে চাই। দেশের জন্য এমন সম্মান বয়ে আনা মেয়েগুলো কেন লোকাল বাসের যাত্রী হয়ে ঈদ করতে বাড়ি যাবে? কেন পথমধ্যে তাঁরা কটুবাক্যের শিকার হবে? কেন তাদের প্রতি কর্তৃপক্ষের এমন উদাসীনতা ও অবহেলা ? তাঁরা কী একটু বিশেষ সুযোগ - সুবিধা, নিরাপত্তা, সম্মান প্রত্যাশা করে না? বাফুফের এমন কান্ডজ্ঞানহীন কর্মকাণ্ডে যারপরনাই বিরক্ত হয়েছি। বলতে দ্বিধা নেই দেশে একমাত্র ক্রিকেটার বাদে অন্যান্য প্রায় সকল খেলোয়ার অবহেলিত। তাদের তেমন গুরুত্ব দেয়া হয় না। ক্রিকেটারদের মত যদিও দেশের অন্যান্য খেলোয়াররাও লাল সবুজের পতাকা বহন করেন। দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনেন, বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। কিন্তু তারপরও এরা প্রায় সময়ই উপেক্ষিত। ক্রিকেটার বাদে অন্যান্য খেলোয়ারদের জন্য বিমানবন্দরে কেউ ফুলের মালা নিয়ে অপেক্ষায় থাকে না ; তাদের অর্জনের জন্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বিশেষ কোন উপহার ঘোষণা করা হয় না। অস্বীকার করছি না দেশের অন্যান্য খেলার তুলনায় ক্রিকেট অনেক দূরে এগিয়ে গেছে। বিশ্ব ক্রিকেটে বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম এখন শক্ত অবস্থানে। এ অর্জন একদিনের না। এর পিছে রয়েছে খেলোয়ারদের কঠোর শ্রম, ত্যাগ ও নিষ্ঠা। আর দেশ ও দেশের জনগণের পৃষ্ঠপোষকতা। দেশে ক্রিকেটকে যে পরিমাণে সাপোর্ট দেয়া হয় অন্যান্য কোন খেলায় তা দেয়া হয় না। দেশে অন্যান্য খেলা যদি এমন পৃষ্ঠপোষকতা পেতো তাহলে হয়ত আমরা সেখান থেকেও ভালো কিছু উপহার পেতাম। অপর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার মাঝেও এরা নিজ মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে আন্তর্জাতিক আসরে প্রতিযোগিতা করে। দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনে। এই বা কম কিসে! সম্প্রতি অনুষ্ঠিত রিও অলিম্পিকে বাংলাদেশ থেকে সাতজন খেলোয়ার অংশগ্রহণ করেছেন। এর মধ্যে একজন সাঁতারু মাহফিজুর রহমান সাগর। অলিম্পিক থেকে দেশে ফিরে বাড়ি যাওয়ার পথে ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন। গণমাধ্যমে এ সংবাদ প্রকাশিত না হলেও ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে ঘটনাটি আমি জানি। এই হচ্ছে দেশের একজন খেলোয়ারের নিরাপত্তা অবস্থা! গত লন্ডন অলিম্পিকে এই মাহফিজুর রহমান সাগর -ই  বাংলাদেশের পতাকা বহন করেছিলেন। খেলোয়াররা দেশের প্রতিনিধি। লাল সবুজের পতাকা তাঁরা বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেন। এসবের বিনিময়ে তাঁরা আমাদের কাছে কিছু চান না। কিন্তু কৃতজ্ঞ জাতি হিসেবে আমরা তাদের প্রতি একটু সম্মান তো দেখাতে পারি। এটা আমাদের দায়িক্ত ও কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। অথচ দেশের মাটিতে মারিয়া সানজিদাদের অপমানিত হতে হয়। দেশসেরা সাঁতারু মাহফিজুর রহমান সাগর অলিম্পিক থেকে দেশে এসে বাড়ি ফেরার পথে ছিনতাইয়ের শিকার হন। বিষয়গুলো ভাবতেই লজ্জা লাগে। আমাদের মানসিক দৈন্যতা কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে! নিঃসন্দেহে এ দৈন্যদশা অবস্থা হতাশার জন্ম দেয়। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন, যে দেশে গুনীর কদর নেই সে দেশে গুনী জন্মাতে পারে না। ঘটে যাওয়া এমন কিছু ঘটনা বিশ্লেষন করলে বোঝা যায় আমাদের দেশে গুনীদের কদর আসলে কতটুকু!

Saturday, 10 September 2016

ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী :হারানো গৌরব ফিরে আসুক


গতকাল ৪ জানুয়ারি ছিল বাংলাদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের জন্মদিন। আজ থেকে ৬৮ বছর আগে ১৯৪৮ সালের এদিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে নাঈমউদ্দিন আহমেদকে আহ্বায়ক করে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে দেশের ঐতিহ্যবাহী এ ছাত্রসংগঠনটি জন্মলাভ করে। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে সংগঠনটির নাম ছিলো ‘ পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ’। স্বাধীনতার পর সংগঠনটির নাম পরিবর্তন করে ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’ করা হয়। দেশের ঐতিহ্যবাহী ও সংগ্রামী ছাত্র সংগঠন হিসেবে দেশের ইতিহাসের সাথে নিবিড়ভাবে এই ছাত্র সংগঠনের নাম জড়িয়ে আছে। এই ছাত্র সংগঠনের অনেক নেতা-কর্মী ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২’র শিক্ষা কমিশন আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান,এগারো দফা আন্দোলনসহ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় স্বাধিকার আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। বর্তমান জাতীয় রাজনীতির অনেক শীর্ষ নেতার রাজনীতিতে হাতেখড়িও এই ছাত্র সংগঠন থেকেই। জাতির জনকের হাতে গড়া ছাত্র সংগঠনটির অতীত অতি গৌরবের। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস!  সময়ের বিবর্তনে আর নীতিহীন রাজনীতির কবলে পড়ে ব্যক্তি স্বার্থের কাছে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের সময় অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী ঐতিহ্যবাহী এই ছাত্র সংগঠনটি এখন আর্দশ বিচ্যুত হয়ে সর্বদাই সমালোচিত ! বিগত সময়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী জুবায়ের আহমেদ হত্যা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দু’পক্ষের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে ছাত্রলীগের নেতা আবদুল্লাহ আল হাসান সোহেলের মৃত্যু,চট্টগ্রামে রেলের দরপত্র জমা দেয়া নিয়ে যুবলীগ-ছাত্রলীগের মধ্যে গোলাগুলিতে আট বছরের শিশু আরমান হোসেন ও যুবক সাজু পালিতের মৃত্যু, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের দু’পক্ষের মারামারিতে রাব্বী নামে এক শিশুর মৃত্যু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এ এফ রহমান হলের ছাত্রলীগের দু’পক্ষের সংঘর্ষের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের মেধাবী ছাত্র আবু বকরের মৃত্যু, ঐতিহ্যবাহী সিলেট এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে আগুন, দর্জি দোকানি বিশ্বজিত্ দাসকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করাসহ এমন অসংখ্য নিন্দনীয় ঘটনার জন্ম দিয়ে বারবার গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে দেশের ঐতিহ্যবাহী এই ছাত্র সংগঠনটি। রাজনীতির মাঠে বর্তমানে প্রতিপক্ষ নেই বললেই চলে। কিন্তু তারপরও কেন জানি এ ছাত্র সংগঠনের অনেক নেতা-কর্মীর মধ্যে বিন্দুমাত্র সহনশীলতা নেই। গণতন্ত্রের চর্চা নেই। বিগত সময়ে অভ্যন্তরীণ কলহের জের ধরে বহুবার এরা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। এসব সংঘর্ষে নিজ দলের নেতা-কর্মীসহ দেশের নিরপরাধ সাধারণ মানুষও রক্ষা পায়নি। এছাড়া সংগঠনটির বিভিন্ন নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে টেন্ডারবাজি, ধর্ষণ,অপহরণ, জমি দখল, চাঁদাবাজি, দরপত্র নিয়ন্ত্রণ, ভর্তিবাণিজ্য, ছিনতাই, রাহাজানি, খুন,গোলাগুলি যেন নিত্যদিনের সংবাদ ! গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে  (১১ আগস্ট ২০১৫) পর্যন্ত এই সাড়ে সাত বছরে ছাত্রলীগ নিজেদের মধ্যে বা অন্য সংগঠনের সঙ্গে কমপক্ষে ৫০০টি সংঘর্ষে জড়িয়েছে। এতে নিহত হয়েছে অন্তত ৫৮ জন। নিজ সংগঠনের ৩৯ জনের বাইরে বাকি ১৫ জনের মধ্যে দুটি শিশু এবং অন্যরা প্রতিপক্ষ সংগঠনের কর্মী বা সাধারণ মানুষ। এসব সংঘর্ষে আহত হয়েছে দুই হাজারের বেশি মানুষ। সামপ্রতিক সময়ে সাধারণ নিরীহ মানুষ, শিক্ষক, পুলিশ সাংবাদিক কেউ-ই এদের হাতে প্রহূত হওয়া থেকে বাদ পড়েনি ! এমনকি পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়স্থল মাতৃগর্ভও  এদের হামলা থেকে রক্ষা পায়নি ! ছাত্রলীগের বর্তমান কর্মকাণ্ডে শুধু দেশের জনগণ না, আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মীও বিরক্ত। বিগত  সময়ে বিভিন্ন নেতার বক্তব্যে এসব বিরক্তির কথা উঠেও এসেছে। কিন্তু তারপরও নেতা-কর্মীর অন্যায় কর্মকাণ্ড থেমে নেই। জাতির জনকের হাতে গড়া ঐতিহ্যবাহী এই ছাত্র সংগঠনটির কি করুণ দশা ! ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়  বাংলাদেশ এখন  ক্রমান্বয়ে উন্নতির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। অস্বীকার করার সুযোগ নেই অন্যান্য সময়ের তুলনায় দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এখন অনেক ভালো। বাংলাদেশ এখন নিম্ন মধ্যম-আয়ের দেশ। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হয়েছে। নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের রোল মডেল। কিন্তু বিগত সময়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগের বিভিন্ন নেতা-কর্মীর বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে সরকারের এসব সাফল্যের সংবাদ ম্লান করে দিচ্ছে। নতুন বছরে এ ছাত্র সংগঠনের কোন নেতা-কর্মী নিজেকে নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে জড়াবে না - এমনটাই প্রত্যাশা। দেশের শান্তিকামী মানুষ নতুন বছরে ঐতিহ্যবাহী এ ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীদের মাঝে সহনশীল আচরণ প্রত্যাশা করে।

এ দেশের মানুষ অস্ত্রের ঝনঝনানি দেখতে চায় না। পেশীশক্তির মহড়া দেখতে চায় না। দেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ের সেই ছাত্রলীগ দেখতে চায়। প্রিয় দেশ ও দেশের জনগণের কল্যাণে যারা সর্বদা নিবেদিত থাকবে। দেশের ঐতিহ্যবাহী এই ছাত্র সংগঠনের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারের জন্য, দেশের ভবিষ্যত্ রাজনীতির গুণগত মান বৃদ্ধি, শিক্ষাঙ্গনের সুষ্ঠু পরিবেশ রক্ষা এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে এর কোন বিকল্প নেই।