Saturday, 9 December 2017

জিম্বাবুয়ের সামরিক অভ্যুত্থান ও রবার্ট মুগাবের পতন


রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে আফ্রিকার দক্ষিণ অংশে অবস্থিত জিম্বাবুয়ে এখন বিশ্ব মিডিয়ার আলোচনার বিষয়বস্তু। রক্তপাতহীন এক সামরিক ‘অভ্যুত্থানের’ মধ্য দিয়ে দেশটির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে সেনাবাহিনী। তারা প্রেসিডেন্ট মুগাবেকে গৃহবন্দী করে ক্ষমতা নিজেদের হাতে নিয়ে নিয়েছে। যদিও সেনাবাহিনীর দাবি, এটা কোন সামরিক অভ্যুত্থান না। তাদের দাবি, রবার্ট মুগাবেকে ঘিরে থাকা অপরাধীদের বিরুদ্ধে তাদের অভিযান। অভিযান শেষে স্থিতাবস্থা ফিরে এলে তারা নির্বাচিতদের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেবে। সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবে তার ভাইস প্রেসিডেন্ট এমারসন এমনাংগাগোয়াকে বরখাস্ত করলে এই রাজনৈতিক সংকটের সূচনা হয়।
এমারসন এমনাংগাগোয়া ষাটের দশক থেকে মুগাবের বিশ্বস্ত সহযোগী। জানু-পিএফ দলে ও সরকারে তিনি দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া তিনি দেশটির মন্ত্রী ও উপ-রাষ্ট্রপতি ছিলেন।
৯৩ বছর বয়সী মুগাবের শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকলে ভাইস প্রেসিডেন্ট এমারসন এমনাংগাগোয়াকে তার সম্ভাব্য উত্তরসূরি মনে করা হচ্ছিল। কিন্তু সবাইকে অবাক করে প্রেসিডেন্ট মুগাবে নিজের অবর্তমানে স্ত্রী গ্রেস মুগাবেকে উত্তরসূরি ঘোষণা করেন। প্রেসিডেন্ট মুগাবের এমন একচ্ছত্র সিদ্ধান্ত তার নিজের দলের সদস্যদের মধ্যেও অসন্তোষ জন্ম দিয়েছে। এ থেকে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক টানাপড়েন। গ্রেসের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট এমারসন এমনাংগাগোয়ার সমর্থনে ক্ষমতাসীন জানু-পিএফ পার্টি দুই ভাগ হয়ে পড়েছে। এমন সংকটময় পরিস্থিতিতে মুগাবে স্ত্রীর পক্ষে এমারসন এমনাংগাগোয়াকে
বরখাস্ত করলে সংকট তীব্র আকার ধারণ করে। এমারসনের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত জিম্বাবুয়ের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল কনস্টান্টিনো চিওয়াঙ্গা বিষয়টি ভালোভাবে নেননি। এরপরই হয় রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থান।
স্বাধীনতা পূর্বে জিম্বাবুয়ে ব্রিটেনের উপনিবেশ ছিল। ১৯৬৫ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত স্বাধীন জিম্বাবুয়ের দাবিতে জিম্বাবুয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়। দেশটি ১৯৮০ সালে ল্যাংকাস্টার হাউস এগ্রিমেন্টের মাধ্যমে অবশেষে স্বাধীন হয়। ১৯৮০ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে মুগাবে জিম্বাবুয়ের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৭০-এর দশকের গেরিলাযুদ্ধের মাধ্যমে মুগাবের নাম ছড়িয়ে পড়ে। ওই সময় জনগণের চোখে তিনি বিপ্লবী ও বীরের মর্যাদা লাভ করেন। কিন্তু পরবর্তীতে রবার্ট মুগাবের গৃহীত একের পর এক বিতর্কিত পদক্ষেপ জনমনে অসন্তোষ জন্ম দেয়। ২০০০ সালে তিনি বিতর্কিত ভূমি সংস্কার জারি করেন। এ সময় তিনি আগ্রাসীভাবে চার হাজারেরও বেশি শ্বেতাঙ্গ কৃষকের কাছ থেকে উর্বর জমি কেড়ে নিয়ে রাজনৈতিক মিত্র ও আত্মীয়-স্বজনদের কাছে এসব জমি বিতরণ করেন, যাদের কৃষিকাজ সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না। ফলে দেশটির অর্থনীতির অন্যতম স্তম্ভ কৃষি খাত প্রায় ধসে পড়ে। রিজার্ভ ব্যাংক অব জিম্বাবুয়ে অতি মূল্যস্ফীতির ভারে একক মুদ্রা ব্যবস্থার পরিবর্তে বাধ্য হয়ে বহু মুদ্রাভিত্তিক মুদ্রানীতি গ্রহণ করে। অর্থনৈতিক সংকট, বেকারত্ব, অপুষ্টি, দরিদ্রতা প্রভৃতি কারণে জিম্বাবুয়ের জনগণের কাছে যে মুগাবে একসময়ে উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে একজন জাতীয়তাবাদী যোদ্ধা হিসেবে প্রশংসিত ছিলেন, সময়ের আবর্তে তিনিই এখন ভিলেন। জনপ্রিয় রাষ্ট্রনায়ক জনবিচ্ছিন্ন রাষ্ট্রনায়কে পরিণত হয়েছেন। এ সত্ত্বেও মুগাবের অতীতের অবদানের কারণে কৃতজ্ঞতাবশত আফ্রিকার বেশিরভাগ নেতা তার সমালোচনা থেকে বিরত থেকেছেন। কিন্তু এবার আর তার শেষ রক্ষা হলো না।
সহজেই অনুমেয় রবার্ট মুগাবে এখন খুব খারাপ সময় কাটাচ্ছেন। তারই ক্ষমতাসীন দল তার ওপর ‘অনাস্থা’ এনে তাকে পদত্যাগ করার আহ্বান জানিয়েছে। হারারের রাস্তায় তার বিরুদ্ধে জনগণ ব্যাপক বিক্ষোভ করছে। জনগণ সেনাবাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণকে মিছিলে স্বাগতম জানাচ্ছে। স্পষ্টত বোঝা যাচ্ছে, জিম্বাবুয়ের জনগণ মুগাবের অপশাসন থেকে মুক্তি চায়। রবার্ট মুগাবের দীর্ঘদিনের মিত্র চীন। স্বৈরাচারী শাসন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনে আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখেও চীন মুগাবেকে সমর্থন করে গেছে। এর আগে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তি যখন মুগাবের সরকারের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করে তখন চীন তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে মুগাবে সরকারের প্রতি চীনের কি ভূমিকা হবে তা বলা বেশ মুশকিল।
সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে অভ্যন্তরীণ অরাজকতা নিরসন করে, অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করে বিভাজিত রাজনৈতিক দল ও জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যে আশ্বাস দেয়া হচ্ছে তা খুব চ্যালেঞ্জিং। কারণ দেশটিতে ৯০ শতাংশের বেশি বেকার। এখন পর্যন্ত দেশটির কোন জাতীয় মুদ্রা নেই। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পূর্বশর্ত। সুতরাং অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দেশটির অর্থনীতি সুদৃঢ় করতে হবে। সেনাবাহিনী যদি বিদ্যমান সমস্যা সমাধান করে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারে তাহলে মুগাবের পতনের মধ্যদিয়ে দেশটিকে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা হবে। এখন দেখার বিষয় পরিস্থিতি কতদিনে স্বাভাবিক হয়, নাকি পরিস্থিতির অবনতি হয়ে আফ্রিকার এ দেশটি গৃহযুদ্ধে জড়াবে।
বৃহস্পতিবার, ২৩ নভেম্বর ২০১৭

No comments:

Post a Comment