Friday, 18 August 2017

দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান জরুরি


গণতন্ত্রপন্থি নেত্রী অং সান সু চি’র ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসির (এনএলডি) রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণের মধ্য দিয়ে দুবছর আগে মিয়ানমারে ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে চলা সামরিক শাসনের অবসান ও গণতান্ত্রিক সরকারের যাত্রা শুরু হয়। সঙ্গত কারণেই সু চি’র দলের কাছে বিশ্ববাসীর প্রত্যাশা একটু বেশি ছিল। সবাই ভেবেছিল, মিয়ানমারে এবার সত্যিকার অর্থে সুশাসন, আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। বিশেষ করে সেদেশের নির্যাতিত রোহিঙ্গা মুসলিমদের প্রত্যাশা ছিল একটু বেশি। রোহিঙ্গারা ভেবেছিল, সু চি’র সরকার তাদের রাষ্ট্রীয় অধিকার ফিরিয়ে দেবে; সুখ-শান্তিতে তারা মিয়ানমারে বসবাস করতে পারবে। নির্বাচনী প্রচারে রাখাইন রাজ্যে গিয়ে সু চি বলেছিলেন, জাতিগত ও ধর্মীয় বঞ্চনা থেকে দেশের মানুষকে রক্ষা করা জরুরি। দেশের সব মানুষকে এক হতে হবে। একে অপরের প্রতি ঘৃণা ও ভীতি প্রদর্শন কোনো সফলতা বয়ে আনে না।
সরাসরি না হলেও তার এ কথায় ভরসা পেয়েছিল রাখাইনে (একসময় আরাকান রাজ্য নামে পরিচিত) বসবাসরত সংখ্যালঘু নির্যাতিত রোহিঙ্গারা। কিন্তু স্বপ্নভঙ্গ হতে তাদের বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসার পরও দেখা গেল তাদের ওপর অত্যাচার থেমে নেই। শান্তিতে নোবেলবিজয়ী অং সান সুচিও ‘রোহিঙ্গা’ ইস্যুতে মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন। মিয়ানমারে ১৩৫টি নৃতাত্ত্বিক জাতি-গোষ্ঠী স্বীকৃত হলেও রোহিঙ্গারা শুধু মুসলিম হওয়ায় সরকারের স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত। কারণে-অকারণে রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার চালায় উগ্রতাবাদী বৌদ্ধরা। এতে অনেকে প্রাণ হারায়, অনেকে দেশত্যাগে বাধ্য হয়। উগ্র বৌদ্ধদের অত্যাচার-নির্যাতন রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত রাষ্ট্রবিহীন সম্প্রদায়ে পরিণত করেছে।
রোহিঙ্গা সমস্যাটি সাম্প্রতিক কোনো ঘটনা নয়। জেনারেল নে উইন সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ১৯৬২ সালে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার পর থেকে রোহিঙ্গাদের ওপর দুর্ভোগ নেমে আসে। সামরিক সরকার তখন বেআইনি অনুপ্রবেশ বন্ধে একটি পদক্ষেপ নেয়। ১৯৭৭ সালে গৃহীত সে পদক্ষেপের ফলে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন নেমে আসে। ১৯৭৮ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ‘নাগামান’ (ড্রাগন রাজা) অভিযানের ফলে প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। তখন বাংলাদেশের ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ-মিয়ানমার দ্বিপক্ষীয় চুক্তি হয়। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্ভব হয় তাতে। কিন্তু মিয়ানমার সরকার ১৯৮২ সালে এমনভাবে আইন সংশোধন করে, যা রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। সামরিক সরকার দাবি করে, ‘রোহিঙ্গা’ বলে কোনো গোত্র তাদের দেশে নেই; এ জনগোষ্ঠী আদতে পূর্ববাংলা থেকে যাওয়া অবৈধ জনগোষ্ঠী, যারা ব্রিটিশ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় পরবর্তী সময়ে মিয়ানমারে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু ইতিহাস বলে, রোহিঙ্গা মুসলিমরা শত বছর ধরে আরাকান রাজ্যে বসবাস করছে; তারা মিয়ানমারের বৈধ নাগরিক। মূলত রোহিঙ্গা মুসলিম সম্প্রদায়ের নাগরিকত্ব অস্বীকারের মাধ্যমে তাদের দেশ থেকে বিতাড়িত করে মিয়ানমারের উগ্র বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী দেশটিকে একটি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাষ্ট্রে পরিণত করতেই এমন কূটকৌশল বেছে নেয়। ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনের প্রেক্ষাপটে সামরিক জান্তা রোহিঙ্গাদের ‘বিদেশি’ হিসেবে চিহ্নিত করে ভোটাধিকার কেড়ে নেয়। ধর্মীয়ভাবেও তাদের ওপর অত্যাচার শুরু হয় তখন। হত্যা-ধর্ষণ হয়ে পড়ে নিয়মিত ঘটনা। তাদের সম্পত্তি কেড়ে নেওয়াসহ বাধ্যতামূলক শ্রমে নিয়োজিত করা হয়। শিক্ষা-স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত করা হয়। বিয়ের অনুমতি দেওয়া হয় না। সন্তান হলে নিবন্ধন বা জাতিগত পরিচয় প্রকাশ করতে দেওয়া হয় না। সংখ্যা যাতে না বাড়ে, সে জন্য তাদের ওপর আরোপিত হয় একের পর এক বিধিনিষেধ।
১৯৯২ সালে আবার নির্যাতন শুরু হলে প্রায় দুই লাখ ৭০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। সর্বশেষ ২০১৬ সালের অক্টোবরে রাখাইনের মংডুতে সীমান্তরক্ষীদের পোস্টে সন্ত্রাসী হামলায় তাদের দায়ী করে সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর ব্যাপক নির্যাতন চালায়। গড়ে অন্তত ৭০ হাজার রোহিঙ্গা কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ায় পালিয়ে আসে বলে বিভিন্ন সূত্রে বলা হয়। ১৯৭৯ সালের পর থেকে যেসব রোহিঙ্গা কক্সবাজারে আশ্রয় নিয়েছিল, মিয়ানমার তাদের অনেককেই আর ফিরিয়ে নেয়নি। দেশটির উগ্র বৌদ্ধদের নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে ঠিক কতজন রোহিঙ্গা শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে ইউএনএইচসিআরের বৈশ্বিক প্রতিবেদন ২০১৬তে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে অনিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা দুই লাখ ৪৩ হাজার। আর তাদের পরিচালিত শরণার্থী শিবিরে রয়েছে ৩৩ হাজার ২০৭ জন। অর্থাৎ সব মিলে মিয়ানমার থেকে আসা নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা দুই লাখ ৭৬ হাজার ২০৭ জন। বাংলাদেশ সরকার এ সংখ্যা তিন থেকে পাঁচ লাখের ভেতর বলে দাবি করে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সরকার স্বাক্ষরিত চুক্তির ছয় মাসের মধ্যে মিয়ানমার সরকার শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেওয়ার কথা। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, মিয়ানমার মাত্র ২২ হাজার শরণার্থীকে তাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করলেও বাকিদের করে না। ফলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সমস্যাটি দুদেশের সম্পর্কে একটি সমস্যা হিসেবেই রয়ে গেছে।
অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশনের (ওআইসি) মহাসচিব ইউসেফ বিন আহমদ আল ওসাইমিনের সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফরের মধ্য দিয়ে ‘রোহিঙ্গা’ ইস্যু নতুন করে আলোচনায় উঠে আসে। চার দিনের এ সফরে দ্বিপক্ষীয় বিষয়াদি আলোচনার পাশাপাশি মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে বড় জোটের এ নেতা কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ানোয় তিনি বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানিয়ে তাদের মানবাধিকার সুরক্ষায় বিশ্বসম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। একই সঙ্গে স্বদেশে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিতে মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। তবে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারে বিশ্বনেতা, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো যত তৎপর, তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে ঠিক কতটুকু তৎপর এ প্রশ্ন করা যেতেই পারে।

রোহিঙ্গা ইস্যুটি এখন আর মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়। বাংলাদেশও এখন এ সমস্যার সঙ্গে জড়িত। মানবিক দিক বিবেচনায় বাংলাদেশ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে সত্য; কিন্তু অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রের সক্ষমতা বিবেচনার সময় হয়ে এসেছে। বাংলাদেশ এমনিতেই নিজের জনসংখ্যার চাপে ন্যুব্জ, নিজেদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতেই হিমশিম খেতে হয়। এর মধ্যে বছরের পর বছর শরণার্থীদের বাড়তি চাপ সহ্যের যৌক্তিকতা ভাববার সময় এসেছে। রোহিঙ্গাদের অনেকেই মাদক, অস্ত্র ব্যবসা ও চোরাচালানিতে যুক্ত হচ্ছেÑএমন খবরও গণমাধ্যমে প্রচার হচ্ছে, যা বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। তাদের অবস্থানের কারণে টেকনাফে সংরক্ষিত বিরল বনাঞ্চল এরই মধ্যে প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। এসব সমস্যা ছাড়াও বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার ভরণ-পোষণের কারণে দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এ সমস্যা কোনো সাময়িক বিপর্যয় নয়, দীর্ঘ কয়েক যুগের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় চলে আসা ‘এথনিক ক্লিনজিং’। তাই এ সমস্যাকে আর মানবিক হিসেবে বিবেচনার সুযোগ নেই। মিয়ানমার সরকার চায়, রোহিঙ্গার দায় সব সময়ের জন্য বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দিতে। দেশটির শাসক গোষ্ঠী প্রকাশ্যেই রোহিঙ্গাদের ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশি’ হিসেবে আখ্যায়িত করে বক্তব্য দিয়ে থাকে। এ জন্য এ সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশকে খুব বেশি সতর্ক হতে হবে। শুধু ভাষা, ধর্ম কিংবা নৃতাত্ত্বিক গঠনে সাদৃশ্য থাকাতেই বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের দায়ভার নিতে পারে না। বাংলাদেশের উচিত হবে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে যত দ্রুত সম্ভব মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা। এ জন্য সার্ক, আসিয়ান, ওআইসিসহ আঞ্চলিক সংস্থাগুলোর দ্বারস্থ হওয়া যেতে পারে। সমস্যাটি জাতিসংঘেও উত্থাপন করা যেতে পারে। রোহিঙ্গারা যেহেতু শুধু মুসলিম হওয়ায় নিজ দেশে অত্যাচারিত, সে ক্ষেত্রে মুসলিম বিশ্বের জোট হিসেবে ওআইসি এ সমস্যা সমাধানে বেশি ভূমিকা রাখতে পারে। আমাদের জন্য রোহিঙ্গা ইস্যু কতটা উদ্বেগজনক, বিশ্বনেতাদের তা অনুধাবন করানোর মাধ্যমে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সমস্যাটি আন্তর্জাতিকীকরণে উদ্যোগ নিতে পারে। তবে এ ইস্যুতে বাংলাদেশ-মিয়ানমার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক যেন নষ্ট না হয়, সেদিকেও সতর্ক থাকতে হবে। কারণ বাংলাদেশের পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে মিয়ানমার একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। সীমান্ত সমস্যা, সমুদ্রসীমা নির্ণয়, সীমান্তে চোরাচালান, রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে দুদেশের মধ্যে দীর্ঘদিন টানাপড়েন চলছে। বর্তমানে দুদেশের সীমান্ত সমস্যা তেমন উল্লেখ করার মতো নয়। সমঝোতার ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক আদাল॥তে সমুদ্রসীমার হিস্যা নির্ধারিত হয়ে গেছে। ইদানীং চোরাচালানও নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে। একমাত্র রোহিঙ্গা সমস্যাই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নে বাধা বলে প্রতীয়মান। তাই এ সমস্যা সমাধানে দুদেশকেই আন্তরিক হতে হবে।

No comments:

Post a Comment