Thursday, 3 August 2017

আরব বসন্ত পরবর্তী ভূ-রাজনীতি ও কাতার সংকট


পারস্য উপসাগরের দেশ কাতার ইস্যুকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে এখন বেশ উত্তপ্ত বাতাস বইছে। কাতারের বিরুদ্ধে ইসলামিক স্টেট (আইএস), মুসলিম ব্রাদারহুড ও আল কায়েদার মতো বিভিন্ন সন্ত্রাসী সংগঠনকে মদত দেয়ার অভিযোগ এনে সৌদি আরব এবং এর চারটি মিত্র আরবদেশ (সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, ইয়েমেন ও মিসর) কাতারের সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য সফরের মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে এই ঘোষণা আসে। এরপর থেকে খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসে সমৃদ্ধ কাতারকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ শুরু হয়।
ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি উত্তপ্ত হতে থাকে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে জামাল উদ্দীন আফগানির নেতৃত্বে সর্ব ইসলামবাদ বা প্যান ইসলামিক আন্দোলন শুরু হয়। এটি একটি ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ আন্দোলন। এ কথা সত্য যে, জামাল উদ্দিন আফগানি ইসলামি আইন ও ধর্মতত্ত্বের চেয়ে রাজনৈতিক দিককেই বেশি আলোকপাত করেছিলেন। প্রাথমিক পর্যায়ে এ আন্দোলন ব্যর্থ হলেও একবিংশ শতাব্দীতে এসে মুসলিম নেতাদের মনে প্যান ইসলামিজমের চেতনা জাগ্রত হয়। এ সময় মিসর ও আরব বিশ্বের অন্যান্য দেশে ইসলামপন্থিদের বিজয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব স্বাভাবিকভাবে নিলেও এক ধরনের শঙ্কায় ছিল। এমতাবস্থায় বৈষয়িক স্বার্থ এবং ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব ও ইসরায়েল মিলে আরব সমাজে নানা ধরনের ফাটল তৈরি করে। আরব জাতির গোষ্ঠী দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে ইসরায়েল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে তাদের স্বার্থ হাসিল করে।
মূলত হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজা পুনর্গঠনে কাতারের বিপুল পরিমাণ আর্থিক সাহায্য দান, মুসলিম ব্রাদারহুডের সহযোগিতা, কাতারভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম আলজাজিরায় ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র স্বার্থবিরোধী সম্প্রচার, কাতারে তুরস্কের সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ এবং কাতারের ঈর্ষণীয় অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন মধ্যপ্রাচ্যে কাতারের বিরুদ্ধে সৌদি আরব ও প্রতিবেশী আরব দেশগুলোর এমন নজিরবিহীন কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞার অন্যতম কারণ। মিসরের ইতিহাসে প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নির্বাচিত মিসরের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করে জেনারেল সিসি ক্ষমতা গ্রহণ করে মুসলিম ব্রাদারহুডের সমর্থকদের উপর নির্যাতন ও দমনমূলক আচরণ শুরু করেন। কাতার তখন জেনারেল সিসির অত্যাচারে দেশ ত্যাগ করা ব্রাদারহুডের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের আশ্রয় দান করে। এছাড়া ‘হামাস’কে কেন্দ্র করে সৌদি আরবের সঙ্গে কাতারের সম্পর্ক শীতল হয়। সৌদি আরব যেসব দাবিতে কাতারকে একঘরে করার চেষ্টা করছে, এর মধ্যে একটি হলো ফিলিস্তিনি মুক্তি আন্দোলন হামাসকে সহায়তা দেয়া বন্ধ করা। কাতার সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গাজা উপত্যকায় নতুন বাড়ি, হাসপাতাল ও সড়ক নির্মাণে কোটি কোটি ডলার ব্যয় করেছে।
সৌদি আরব ও তার চার মিত্র প্রতিবেশী দেশ সম্পর্কচ্ছেদ করার পর থেকে কাতার এখন মারাত্মক চাপের মুখে পড়েছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে তীব্র খাদ্য সংকট, কারণ কাতারকে তার প্রয়োজনীয় খাদ্য চাহিদার প্রায় ৯৮ শতাংশ আমদানি করতে হয়। অবরোধের কারণে সমুদ্র ও আকাশপথে কাতারকে খাদ্য আমদানি করতে হচ্ছে। ইরান আকাশপথে ও জাহাজে করে কাতারে প্রয়োজনীয় খাদ্যের জোগান দিচ্ছে।
সৌদি জোট কাতারের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা ও অবরোধ তুলে নেয়ার শর্ত হিসেবে ১৩ দফা দাবি পেশ করেছে। এসব দাবির মধ্যে ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক হ্রাস, সন্ত্রাসী সংগঠন মুসলিম ব্রাদারহুড, হামাস, আল কায়েদা ও আইএসের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা, আমিরাতে তুরস্কের সামরিক ঘাঁটি বন্ধ করা, সৌদি জোট ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেসব সংগঠনকে সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা করেছে তাদের আর্থিক সাহায্য দান বন্ধ করা, কাতারভিত্তিক আলজাজিরা চ্যানেল বন্ধ করে দেয়া, সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় চার দেশ ও মিসরের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ না করা, সৌদি আরব, বাহরাইন, মিসর ও আমিরাত যেসব ব্যক্তিকে সন্ত্রাসী ঘোষণা করেছে তাদের স্থানান্তর করা এবং এসব দেশের ভিন্নমতাবলম্বী রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করা প্রভৃতি অন্যতম। সৌদি জোট যে শর্তগুলো দিয়েছে তার অনেকগুলোই কাতারের জাতীয় স্বার্থ পরিপন্থী।
যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল এবং মিসরবিরোধী সম্প্রচারের জন্য আলজাজিরা বন্ধের দাবি উঠেছে, কাতার এটা মেনে নেবে না। কাতারের নিরাপত্তার স্বার্থে তুরস্ক যে সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করেছে কাতার এটাও বন্ধ করবে না, এটাই স্বাভাবিক। আবার কাতার নিজেদের নিরাপত্তার খাতিরে ইরানের সঙ্গেও সম্পর্ক নষ্ট করবে না। সবচেয়ে বড় কথা জাতীয় স্বার্থে একটি স্বাধীন দেশ অন্যান্য কোন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে কি রাখবে না সেটা একান্ত ব্যক্তিগত, এক্ষেত্রে অন্য দেশের হস্তক্ষেপ স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি। তারপরও কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি সর্বশেষ ভাষণে সৌদি আরবসহ চার আরব প্রতিবেশী দেশের নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার জন্য আলোচনার আহ্বান জানিয়েছেন। এখন দেখার বিষয় এ আহ্বানে প্রতিপক্ষ আদৌও সাড়া দেয় কি-না, নাকি বিদ্যমান সংকট যুদ্ধে রূপ নেয়।
তবে খেয়াল করে দেখার মতো বিষয় হচ্ছে কাতারের বিরুদ্ধে সৌদি-বাহরাইন-মিসর-দুবাই অক্ষশক্তির অর্থনৈতিক অবরোধ কাতার ছাড়াও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে ফিলিস্তিনিদের ওপর। বিশেষ করে গাজার মানুষ এতে বিপাকে পড়বে। দাবি করা হচ্ছে ২০১৪ সালে ইসরায়েলের হামলায় ধ্বংসপ্রায় গাজায় মূলত কাতারের অর্থেই হামাস পুনর্গঠন কার্যক্রম চালাচ্ছিল। কাতার সেখানে ১ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দেবে বলেও অঙ্গীকার করেছিল তখন। খবরে প্রকাশ ২০১৬-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত তার প্রতিশ্রুত সহায়তার প্রায় এক পঞ্চমাংশ দিয়েও দিয়েছে। এদিকে সৌদি আরবের সাম্প্রতিক অবরোধে কাতার এখন নিজেই বিপন্ন। ফলে তারা গাজায় প্রদত্ত সহায়তা কাটছাঁট করতে বাধ্য হবে। হামাসের সঙ্গে কাতারের এই নৈকট্যই সৌদি-কাতার মনোমালিন্যের মূল কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। ফলে এই অবরোধের মূল সুবিধাভোগী হবে ইসরায়েল। ফলে কাতার এখন থেকে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলনের বদলে বিপাকে পড়ে ইসরায়েলের পক্ষে কথা বলতে বাধ্য হবে। আর হামাসকে প্রকাশ্যে কম সহায়তা দেয়ার প্রেক্ষাপট তো আগেই তৈরি হয়ে গেছে। ফলে সৌদি আরবের এই পদক্ষেপে আর কেউ না হোক ইতোমধ্যই সব থেকে সুবিধাভোগী হয়েছে ইসরায়েল।
মনে করে দেখা যায়, কাতারের সঙ্গে মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুডের দহরম-মহরমও চলতি বিবাদের অন্যতম কারণ। ব্রাদারহুডবিরোধী মিসরের জেনারেল সিসি এই অবরোধে বিশেষভাবে মদত দিচ্ছে শুধুমাত্র তার স্বার্থে। পাশাপাশি কাতারস্থ প্রচার মাধ্যম আল-জাজিরার ভূমিকায় জেনারেল আল-সিসি ক্ষুব্ধ। বিশেষ করে ক্ষমতা গ্রহণ করতে গিয়ে তার গণহত্যা, নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে ব্রাদারহুডের কর্মীদের উপর নির্যাতন এর পুরোটাই ফলাও করে প্রচার করেছে আল-জাজিরা। পাশাপাশি ‘আরব বসন্ত’- সময়কালেও আল-জাজিরার উৎসাহমূলক ভূমিকা অস্বীকারের সুযোগ নাই। এর বাইরে মিসরের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি নিয়ে এই সংবাদ মাধ্যমটি যা প্রচার করছে তার সবকিছু সামরিক জান্তা সিসির জন্য বিব্রতকর ও অপমানজনক। অন্যদিকে সৌদ রাজ পরিবারের নানা কুকর্মের দলিল সরাসরি বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরায় সৌদি আরবের বিস্তর ক্ষোভ গিয়ে জমেছে কাতার ও তাদের এই চ্যানেলটির ওপর।
খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। সৌদি বাহিনীর বোমা নিক্ষেপে একটি শবযাত্রায় অসংখ্য বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছিল। এই সংবাদ ফলাও করে প্রচার করেছিল আল-জাজিরা। এর বাইরে ইয়েমেন যুদ্ধ এবং সৌদি আরবের বাহরাইনে আগ্রাসন নিয়ে আল-জাজিরার প্রচার সৌদি আরবকে বিপাকে ফেলেছে। বলতে গেলে এই আল-জাজিরাসহ মধ্যপ্রাচ্য ও উপসাগরজুড়ে স্বাধীন গণমাধ্যমে মুক্তমত প্রকাশের সুযোগ সৃষ্টিতে কাতারের ভূমিকা অস্বীকারের সুযোগ নাই। বিশ্বের সবাই জানে যে সৌদি যুবরাজ সালমান এবং আবুধাবির যুবরাজ জায়েদ মিসরের গণতান্ত্রিক সরকারে থাকা মুসলিম ব্রাদারহুডকে ক্ষমতাচ্যুত করার ক্ষেত্রে জেনারেল সিসি ও দেশটির সামরিক বাহিনীকে বিশেষ সহায়তা দিয়েছিল। ফলে তারা সরাসরি কাতারের বিপক্ষে যাবে এটা নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নাই। এদিকে অনেকদিন ধরে সৌদি আরব কাতারের কাছ থেকে বাহরাইনের মতো পদলেহি আচরণ আশা করে ব্যর্থ। পাশাপাশি কাতারের স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি তাদের মধ্যে উদ্বেগ জন্ম দিয়েছে। ফলে মিসর-সৌদি আরব-দুবাই জোট তাই কাতারবিরোধী অবরোধ এমন এক সময়ে করেছে যখন দেশটি ২০২২ এর বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজনের প্রস্তুতিমূলক কাজে ব্যস্ত। তারা মনে করছে এতে ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে এবং তারা চাপে থাকবে। তবে আরব বসন্ত পরবর্তীকালে মধ্যপ্রাচ্চের ভূ-রাজনীতিতে যে পরিবর্তন এসেছে এই অবরোধ তারই পরোক্ষ ফল। এখনও এই নাটকের অনেক অংক মঞ্চস্থ হওয়ার বাকি আছে।

No comments:

Post a Comment