উত্তরাঞ্চলসহ
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি এখনো উদ্বেগজনক। স্মরণকালের এই ভয়াবহ
বন্যায় এরই মধ্যে দেশের ২১টি জেলা মারাত্মকভাবে প্লাবিত হয়েছে। এর বাইরেও পার্বত্য
অঞ্চলের কিছু এলাকা বন্যায় আক্রান্ত। ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, আত্রাই, সুরমাসহ কয়েকটি
নদ-নদীর পানি এখনো বিপত্সীমার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। এছাড়া পদ্মা নদীর পানি বৃদ্ধি
অব্যাহত থাকার কারণে দেশের মধ্যাঞ্চলেও বন্যার আশঙ্কা করছে বিশেষজ্ঞ মহল। অর্থাত্
বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে আরো নতুন কিছু জেলা বন্যাকবলিত হতে পারে।
ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশ প্রায়
প্রতি বছরই বন্যাকবলিত হয়। অতিবৃষ্টির ফলে নদীর পানি উপচে লোকালয়ে প্রবেশ করে
বন্যার সৃষ্টি করে। বন্যায় বিশেষ করে দেশের উপকূলীয় ও নিম্নাঞ্চল বেশি ক্ষতিগ্রস্ত
হয়। কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়া ও সিরাজগঞ্জ— এসব জেলার নিম্নাঞ্চল
একটু ভারি বৃষ্টিপাত হলে সহজেই বন্যাকবলিত হয়। নদী-নালা, খাল-বিল প্লাবিত হয়ে
বন্যার পানি উপচে পড়ে সমতল ভূমিতে। রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, স্কুল-কলেজ সবই তখন অথৈ জলে
ভাসে।
অতিরিক্ত বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে দেশের কয়েক
লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে এখন মানবেতর জীবনযাপন করছে। বন্যার কারণে এরই মধ্যে
অসংখ্য পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়েছে। নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে অনেকের বসতবাড়ি। এখন
পর্যন্ত পাওয়া তথ্যমতে, দেশের ২১ জেলায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩২ লাখ ৮৭ হাজার
মানুষ। মহাসড়কে পানি ওঠায় বিভিন্ন জেলায় সরাসরি পথে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। এছাড়া
খবরে প্রকাশ লালমনিরহাট, দিনাজপুর ও ঠাকুরগাঁওয়ে তিনটি পথে রেলযোগাযোগ বন্ধ রয়েছে।
বন্যায় কৃষকের প্রায় ১ লাখ ৭২ হাজার ২১৭ হেক্টর ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বলতে
গেলে, এক প্রকার বানের জলে ভাসছে সাধারণ মানুষের নিয়তি। এসব বানভাসি মানুষের
মানবেতর জীবনের গল্প গণমাধ্যমে সচিত্র প্রতিবেদনসহ প্রকাশ হচ্ছে। দুর্গত মানুষের
দুর্ভোগের কথা লিখে বোঝানো সম্ভব না।
বন্যাকবলিত এলাকায় যে ত্রাণসামগ্রী দেয়া
হচ্ছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল; তাও বন্যার্তদের অনেকেই পাচ্ছে না বলে
অভিযোগ। অভিযোগ যদি সত্য হয়, তাহলে এটি খুবই দুঃখজনক। সরকারের উচিত এ বিষয়ে কঠোর
হওয়া, যাতে অসহায় মানুষের মুখের অন্ন কেউ কেড়ে খেতে না পারে। বানভাসি একজন মানুষও
যেন খাদ্যাভাবে, সাহায্যের অভাবে, চিকিত্সার অভাবে মারা না যায়, সেদিকে আমাদের
লক্ষ রাখা উচিত। বন্যার্ত মানুষের জন্য পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী ও চিকিত্সার ব্যবস্থা
করা শুধু সরকারের নয়, সবার মানবিক দায়িত্ব। তাদের প্রতি সবাইকে সদয় হতে হবে।
বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলে আবার নতুন
সমস্যা দেখা দেবে। বন্যাকবলিত অঞ্চলের অনেকেই পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হবে। দেখা
দেবে পানিবাহিত বিভিন্ন রোগ। বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের অভাবে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়বে।
তাই বন্যা-পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণেও সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে। বন্যায় মানুষের
দুর্ভোগের পাশাপাশি অর্থনৈতিক ক্ষতি তো আছেই। ঘরবাড়ি, গৃহপালিত পশু, ফসলি জমি,
মাছের ঘের, বীজতলা প্রভৃতি নষ্ট হওয়ার কারণে অনেকে মারাত্মক সংকটে পড়বে, তাদের স্বাবলম্বী
করার জন্য সরকারকে আর্থিক সহায়তা দিতে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর অনেকেই সব
হারিয়ে দেউলিয়া হয়ে যায়। অনেকে আর্থিক সচ্ছলতার জন্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত
হয়, যা সামাজিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে। সুতরাং ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পুনর্বাসনের
ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে দেশে সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত
কৃষকের ব্যাংকঋণ মওকুফের পাশাপাশি চাষাবাদের জন্য প্রয়োজনীয় কৃষিপণ্য বিনামূল্যে
সরবরাহ করতে হবে। রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রভৃতি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে
নির্মাণ করতে হবে।
বন্যা একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলেও
সম্মিলিতভাবে তা মোকাবেলা করা অসম্ভব নয়। বন্যাকবলিত মানুষের সাহায্যার্থে তাই
সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন সামাজিক
সংগঠন, ছাত্রসমাজ ও সমাজের বিত্তশালী মানুষের এগিয়ে আসতে হবে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত
এলাকার মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী ও চিকিত্সা
সরবরাহ করতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত একজন মানুষও যেন সাহায্যের অভাবে নিজেকে অসহায় না
ভাবে, সেদিকে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে।
No comments:
Post a Comment