মার্চ মাস আমাদের জাতীয় জীবনে অন্যান্য মাসের তুলনায় এর গুরুত্ব একটু
বেশিই। ২৬ মার্চ আমাদের স্বাধীনতা দিবস; এদিন আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের
স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু হয়। এ মাসে জন্ম নিয়েছেন আমাদের স্বাধীনতার স্থপতি
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যার জন্ম না হলে হয়তো বাংলাদেশ স্বাধীনই হতো
না। এ মাসেই আমাদের স্বাধীনতার নায়ক শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রেসকোর্স
ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) লাখো মানুষের সমাবেশে জাতির উদ্দেশে
এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ প্রদান করেছিলেনÑইতিহাসখ্যাত ৭ মার্চের ভাষণ।
বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণ স্বাধীনতাকামী বাঙালি জাতির অনুপ্রেরণা হিসেবে বিবেচনা
করা হয়। এটি মুক্তিবাহিনীতে যোগদানকারী মুক্তিযোদ্ধাদের অংশগ্রহণের অন্যতম
প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল। ৭ মার্সের বিখ্যাত ভাষণের মধ্যে বাঙালির
মুক্তির বার্তা ছিল। এ ভাষণে তিনি বাঙালিদের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য
প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান। এরপর শুরু হয় দীর্ঘ সংগ্রাম; যার ফলে আমরা
পেয়েছি লাল সবুজের পতাকা। ঐতিহাসিক এ ভাষণের গুরুত্ব অনুভব করে গত বছর
ইউনেসকো ৭ মার্চের ভাষণকে ‘ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ (বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য)
হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের এবং গর্বের বিষয়।
গৌরবান্বিত এ ঘটনাকে উদযাপনের জন্য সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নাগরিক
সমাবেশের আয়োজন করা হয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসংখ্য মানুষ
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমবেত হয়। এ পর্যন্ত সবই ঠিক ছিল। কিন্তু বিপত্তি ঘটল
যখন ৭ মার্চ উপলক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত জনসভাকে কেন্দ্র করে
রাজধানীর শাহবাগসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় বেশ কিছু নারী ইভটিজিং ও হয়রানির
শিকার হলেন। অশ্রাব্য গালি থেকে শুরু করে তাদের গায়ে বোতলের পানি ছিটিয়ে
দেওয়া, বোতল ছুড়ে মারা এবং ঘিরে ধরে শারীরিকভাবে হেনস্তা করার মতো ঘটনা
ঘটেছে বলে অভিযোগ ওঠে। ভুক্তভোগী নারীদের কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগের
মাধ্যমে এসব ঘটনার কথা তুলে ধরেছেন। চারিত্রিক ও নৈতিক মূল্যবোধ কোথায় গিয়ে
নেমেছে! একটা স্বাধীন দেশে, ঐতিহাসিক একটি মুহূর্ত উদযাপনকে কেন্দ্র করে
নারীরা লাঞ্ছিত হয়, হেনস্তার শিকার হয়, সিসি ক্যামেরা ও শত শত আইনশৃঙ্খলা
বাহিনীও সেদিন তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। ভুক্তভোগীদের অবস্থাটা
চিন্তা করলে শরীরের লোম খাঁড়া হয়ে যায়। এ ঘটনায় আমাদের মাননীয়
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, দোষীদের আইনের আওতায় এনে বিচার করা হবে। কিন্তু
তার এ কথায় কতটুকু আস্থা রাখা যায়? যতদূর জানি, আজ অবধি এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত
কোনো অপরাধীকে গ্রেফতার করাও সম্ভব হয়নি। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত
করা তো অনেক দূরের বিষয়। গত বছরের পহেলা বৈশাখে নববর্ষের উৎসবে ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি-সংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ফটকে ঠিক একইভাবে
নারী লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটেছিল। প্রমাণসহ সেই ঘটনা সামাজিক ও গণমাধ্যমে
প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু ওই ঘটনায় অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক কোনো শাস্তি
হয়েছে এমন খবর আজও শুনিনি। সুতরাং এবারের ঘটনায় দোষীদের যে বিচার হবে,
দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে রাষ্ট্রের ওপর এমন আস্থা কীভাবে রাখি? এসব
কুলাঙ্গারদের বিচার না হওয়ার সঙ্গে ক্ষমতার কু-প্রভাব জড়িত থাকে। যেসব
অপরাধী ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত নয়, দেখা যাচ্ছে তাদের বিচার হয়। আর যারা
ক্ষমতার সঙ্গে জড়িত, তারা বিচারের বাইরে থেকে যায়। অপরাধ করে দিব্যি বুক
ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়। নতুন অপরাধের জন্ম দেয়। এদের শাস্তি হয় তখনই, যখন জনগণ
আন্দোলন করে রাষ্ট্রকে বাধ্য করে।
রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনে নারীর সম-অধিকার, মর্যাদা ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার
জন্য বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও প্রতি বছর নানা কর্মসূচির
মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপিত হয়। এ বছরও চলতি মাসের ৮ তারিখে
দিবসটি পালিত হয়েছে। নারী সম-অধিকার ও ক্ষমতায়ন বিষয়ে সারা বিশ্ব এখন
সোচ্চার। নারীরাও এখন নিজেদের অধিকারের বিষয়ে অনেক বেশি সচেতন। ফলে জেন্ডার
সমতার বিষয়টি পুরোপুরিভাবে প্রতিষ্ঠিত না হলেও আগের তুলনায় নারীর অবস্থার
অনেকটা উন্নতি হয়েছে। ঊনবিংশ শতকে বাঙালি নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া
সাখাওয়াত হোসেন সমাজজীবনে সর্বক্ষেত্রে নারীদের পশ্চাৎপদতার আক্ষেপ করে
বলেছিলেন, স্বামী যখন পৃথিব থেকে সূর্য ও নক্ষত্রের দূরত্ব মাপেন, স্ত্রী
তখন একটা বালিশের ওয়াড়ের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ (সেলাই করার জন্য) মাপেন! স্বামী
যখন কল্পনা-সাহায্যে সুদূর আকাশে গ্রহ-নক্ষত্রমালা-বেষ্টিত সৌরজগতে বিচরণ
করেন, সূর্যম-লের ঘনফল তুলাদ-ে ওজন করেন এবং ধূমকেতুর গতি নির্ণয় করেন,
স্ত্রী তখন রন্ধনশালায় বিচরণ করেন, চাল-ডাল ওজন করেন এবং রাঁধুনির গতি
নির্ণয় করেন। দেশে নারীদের এখন আর সেই আগের অবস্থা নেই। মানুষের
দৃষ্টিভঙ্গিরও অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে। নারীরাও এখন রান্নাঘর থেকে
বেরিয়ে এসেছে। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে
মেধা ও কর্মদক্ষতার পরিচয় দিয়ে প্রমাণ করেছে তারা শুধু সন্তান উৎপাদন ও
পুরুষের মনোরঞ্জনের জন্য পৃথিবীর বুকে আসেনি। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর নারীর
ক্ষমতায়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশের নারীরা দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে।
বাংলাদেশ এখন নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বিশ্বের রোল মডেল। বর্তমান সরকারের
প্রধানমন্ত্রী, সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা, সংসদের বাইরে বিরোধী দলের নেতা,
সংসদ উপনেতা ও স্পিকার প্রত্যেকেই নারী। এ ছাড়া প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে
নারীরা মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। নারী জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে
পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে নিজেদের যোগ্যতায় এবং রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় সামনে
এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের রফতানি আয়ের একটি অন্যতম বড় উৎস তৈরি পোশাক খাত।
দেশের রফতানি আয়ের একটি সিংহভাগ আসে এ খাত থেকে। দেশের পোশাকশিল্পে নিয়োজিত
অধিকাংশ শ্রমিক নারী। এ ছাড়া কৃষিক্ষেত্রেও নারীদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নারীরা দেশের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে।
কিন্তু দুঃখজনক সত্ত্বেও নারী নির্যাতন ও লাঞ্ছনা থেকে নেই। অর্থনৈতিক
স্বাধীনতা অর্জন করেও দেখা যাচ্ছে নারী তাদের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা ও
মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যৌতুকপ্রথা, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, ধর্মীয়
কুসংস্কার, পারিবারিক জীবনে পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের আধিপত্য, সমাজে
বিদ্যমান মান্ধাতা আমলের প্রথা, কুসংস্কার, ইভটিজিং নামক সামাজিক ব্যাধি
ইত্যাদি নারীর সম-অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে
দাঁড়াচ্ছে। অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ও সামাজিক
কর্মকা-ে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে এটা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু
নারী নির্যাতন ও বঞ্চনা থেমে নেই। আন্তর্জাতিক আইন ও সনদের পাশাপাশি দেশে
নারী অধিকার সুরক্ষায় আইন রয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, নারীরা আজও
পরিবারে, সমাজে ও রাষ্ট্রে শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক, যৌন নির্যাতনসহ
প্রতিনিয়ত বিভিন্ন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। বেসরকারি একটি সংস্থার রিপোর্টে
দেখা যাচ্ছে, ২০১৭ সালে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৫ হাজার ৫৮৩ জন
নারী, আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে ৭৫৭ জন, মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে
৬২৮ জন ও অন্যান্য ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৮৮৮ জন। বাস্তবে এ
সংখ্যাটা হয়তো আরো বেশি হবে। কারণ নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলোয় ভুক্তভোগীদের
অনেকেই সামাজিক মর্যাদাহানির ভয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে চুপ থাকে। এ থেকে বোঝা
যায়, দেশে জেন্ডার সমতার বিষয়টি পুরোপুরিভাবে আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এর জন্য
পুরুষ সমাজ যে এককভাবে দায়ী ব্যাপারটা এমনও না। অনেক সময় দেখা যায় নারী
দ্বারাই নারী নির্যাতিত হচ্ছে। এ জন্য নারীবাদী কিংবা পুরুষবাদী না হয়ে,
সবাইকে মানবতাবাদী হওয়াটা খুব বেশি দরকার।
দেশের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী। বৃহৎ এ জনগোষ্ঠীকে পেছনে ফেলে
কাক্সিক্ষত উন্নয়ন সম্ভব না। কাক্সিক্ষত উন্নয়নের জন্য নারীর সম-অধিকার ও
মর্যাদা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন অবশ্যই প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতা বন্ধ করতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
নারীরাও সমাজের অংশ এবং আমাদের সার্বিক উন্নয়নের অংশীদার এই বোধ সবার মধ্যে
জাগ্রত করতে হবে। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তন এবং আইনের
প্রয়োগই পারে সাম্যের সমঝোতামূলক বৈষম্যহীন শান্তির সমাজব্যবস্থা গড়তে।
No comments:
Post a Comment