Friday, 18 August 2017

রোহিঙ্গা সমস্যা : মায়ানমারের বর্বর নীতির দায়ভার বাংলাদেশ বহন করবে কেন?


অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশনের (ওআইসি) মহাসচিব ইউসেফ বিন আহমদ আল ওসাইমিন-এর সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফরের মধ্য দিয়েরোহিঙ্গাইস্যু নতুন করে আলোচনায় উঠেছে। চারদিনের সফরে তিনি দ্বিপক্ষীয় বিষয়াদি আলোচনার পাশাপাশি মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে বড় জোটের এই নেতা কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন। ক্যাম্প পরিদর্শন শেষে রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য তিনি বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানিয়ে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার সুরক্ষায় বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আর্কষণ করেছেন। একইসঙ্গে স্বদেশে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেয়ার জন্য মায়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তবে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দেয়ার ব্যাপারে বিশ্বনেতা/আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো যতটা তৎপর রোহিঙ্গাদের মায়ানমারে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে ঠিক কতটুকু তৎপর প্রশ্ন হয়ত করা যেতেই পারে।
রোহিঙ্গা সমস্যাটি সাম্প্রতিক কোন ঘটনা না। জেনারেল নে উইন সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ১৯৬২ সালে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার পর থেকে রোহিঙ্গাদের ওপর দুর্ভোগ নেমে আসে। সামরিক সরকার তখন সে দেশে বে-আইনি অনুপ্রবেশ বন্ধ করার জন্য একটি পদক্ষেপ নেয়। ১৯৭৭ সালে সামরিক জান্তা সরকার গৃহীত সেই পদক্ষেপের ফলশ্রুতিতে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন নেমে আসে। ১৯৭৮ সালে মায়ানমার সেনাবাহিনীর নাগামান (ড্রাগন রাজা) অভিযানের ফলে প্রায় দুই লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। কিন্তু তখন বাংলাদেশের ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ-মায়ানমার দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যার ফলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্ভব হয়। কিন্তু মায়ানমার জান্তা সরকার ১৯৮২ সালে এমনভাবে নাগরিক আইন সংশোধন করে যা রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। সামরিক সরকার দাবি করে রোহিঙ্গা বলে কোন গোত্র তাদের দেশে নেই, এই জনগোষ্ঠী আদতে পূর্ব বাংলা থেকে যাওয়া অবৈধ জনগোষ্ঠী, যারা ব্রিটিশ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় পরবর্তী মায়ানমারে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু ইতিহাস বলে, রোহিঙ্গা মুসলমানরা শত বছর ধরে আরাকান রাজ্যে বসবাস করছেন। এবং তারা মায়ানমারের বৈধ নাগরিক। মূলত রোহিঙ্গা মুসলমান সম্প্রদায়ের নাগরিকত্ব অস্বীকার করার মাধ্যমে, তাদের দেশ থেকে বিতাড়িত করে মায়ানমারের উগ্র-মৌলবাদী বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী মায়ানমারকে একটি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্যই এমন কূটকৌশল বেছে নেয়। ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনের প্রেক্ষিতে সামরিক জান্তা রোহিঙ্গাদের বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত করে ভোটাধিকার কেড়ে নেয়। ধর্মীয়ভাবেও তাদের উপর অত্যাচার শুরু হতে থাকে তখন। হত্যা-ধর্ষণ হয়ে পড়ে যেন নিয়মিত ঘটনা। তাদের সম্পত্তি জোর করে কেড়ে নেয়া হয়। বাধ্যতামূলক শ্রমে নিয়োজিত করা হয়। তাদের শিক্ষা-স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়। বিয়ে করার অনুমতি দেয়া হয় না। সন্তান হলে নিবন্ধন করা হয় না। জাতিগত পরিচয় প্রকাশ করতে দেয়া হয় না। সংখ্যা যাতে না বাড়ে, সে জন্য তাদের ওপর আরোপিত হয় একের পর এক বিধিনিষেধ। ১৯৯২ সালে রোহিঙ্গাদের ওপর পুনরায় নির্যাতন শুরু হলে তখন প্রায় লাখ ৭০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। সর্বশেষ ২০১৬ সালের অক্টোবরে রাখাইনের মংডুতে সীমান্তরক্ষীদের পোস্টে সন্ত্রাসী হামলায় রোহিঙ্গাদের দায়ী করে সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর ব্যাপক নির্যাতন চালায়। সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে কমপক্ষে ৭০ হাজারের মতো রোহিঙ্গা কক্সবাজারের টেকনাফ উখিয়ায় পালিয়ে আসে বলে বিভিন্ন সংস্থা সূত্রে বলা হয়। ১৯৭৯ সালের পর থেকে যেসব রোহিঙ্গা কক্সবাজারে আশ্রয় নিয়েছিলেন মায়ানমার তাদের অনেককেই আর ফিরিয়ে নেয়নি। মায়ানমারের উগ্র মৌলবাদী বৌদ্ধদের নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে ঠিক কতজন রোহিঙ্গা মুসলিম শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে তার সঠিক কোন পরিসংখ্যান নেই। তবে ইউএনএইচসিআরের বৈশ্বিক প্রতিবেদন ২০১৬তে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে অনিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা লাখ ৪৩ হাজার। আর তাদের পরিচালিত শরণার্থী শিবিরে রয়েছে ৩৩ হাজার ২০৭ জন। অর্থাৎ সব মিলে বাংলাদেশে মায়ানমার থেকে আসা নিবন্ধিত অনিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা দাঁড়ায় লাখ ৭৬ হাজার ২০৭। বাংলাদেশ সরকার সংখ্যা তিন থেকে পাঁচ লাখের ভেতর বলে দাবি করে। বাংলাদেশ-মায়ানমার সরকারের মধ্যে স্বাক্ষরিত এক চুক্তির ফলে ১৯৯২ সালের ১৫ মে মাসের মধ্যে মায়ানমার সরকার শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেয়ার কথা। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে মায়ানমার সরকার মাত্র ২২ হাজার শরণার্থীকে তাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে। বাকিদের নাগরিক হিসেবেই স্বীকার করে না। ফলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সমস্যাটি দুদেশের সম্পর্কের মধ্যে অন্যতম একটি সমস্যা হিসেবে রয়েই গেছে।
রোহিঙ্গা ইস্যুটি এখন আর মায়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয় নেই। বাংলাদেশও এখন সমস্যার সাথে বেশ ভালোভাবে জড়িত। মানবিক দিক বিবেচনা করে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে সত্য কিন্তু এখন অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং রাষ্ট্রের সক্ষমতা বিবেচনা করার সময় এসেছে। বাংলাদেশ এমনিতেই নিজের জনসংখ্যা চাপে ন্যুব্জ, নিজেদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতেই হিমশিম খেতে হয়; এরমধ্যে বছরের পর বছর শরণার্থীদের বাড়তি চাপ সহ্য করার যৌক্তিকতা ভাববার সময় এসেছে। রোহিঙ্গাদের অনেকেই মাদক ব্যবসা, অস্ত্রব্যবসা, এবং চোরাচালানির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে এমন খবরও গণমাধ্যমে প্রচার হচ্ছে, যা বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের অবস্থানের কারণে টেকনাফে সংরক্ষিত বিরল বনাঞ্চল এরই মধ্যে প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। এসব সমস্যা ছাড়াও বিরাট অংকের রোহিঙ্গাদের ভরণ-পোষণের কারণে এদেশের অর্থনীতির ওপরে তার প্রভাব পড়ছে। রোহিঙ্গা সমস্যা কোন সাময়িক বিপর্যয় নয়, দীর্ঘ কয়েক যুগের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় চলে আসা এথনিক ক্লিনজিং। তাই এই সমস্যাকে আর মানবিক হিসেবে বিবেচনা করার কোন সুযোগ নেই। মায়ানমার সরকার চায় রোহিঙ্গার দায় সব সময়ের জন্য বাংলাদেশের কাঁধে চাপিয়ে দিতে। মায়ানমারের শাসকগোষ্ঠী প্রায়ই প্রকাশ্যে এই রোহিঙ্গাদের অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশি হিসেবে আখ্যায়িত করে বক্তব্য দিয়ে থাকেন। জন্য সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশকে খুব বেশি সতর্ক হতে হবে। শুধু ভাষা, ধর্ম কিংবা নৃতাত্ত্বিক গঠনে সাদৃশ্য থাকার কারণেই বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের দায়ভার নিতে পারে না। বাংলাদেশের উচিত হবে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে যত দ্রুত সম্ভব মায়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা। মায়ানমারের উপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য সার্ক, আসিয়ান, ওআইসিসহ আঞ্চলিক সংস্থাগুলোর দারস্থ হওয়া যেতে পারে। প্রয়োজনে সমস্যাটি জাতিসংঘেও উত্থাপন করা যেতে পারে। রোহিঙ্গারা যেহেতু শুধু মুসলিম হওয়ার কারণে নিজদেশে অত্যাচারিত, এক্ষেত্রে মুসলিম বিশ্বের জোট হিসেবে ওআইসি সমস্যা সমাধানে খুব বেশি ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশের জন্য রোহিঙ্গা ইস্যু কতটা উদ্বেগজনক, বিশ্বনেতাদের তা অনুধাবন করানোর মাধ্যমে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সমস্যাটি আন্তর্জাতিকীকরণ করার উদ্যোগ নিতে পারে। তবে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ-মায়ানমার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক যেন নষ্ট না হয় সেদিকেও সতর্ক থাকতে হবে। কারণ বাংলাদেশের পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে মায়ানমার একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। দুদেশের সীমান্ত সমস্যা, সমুদ্রসীমা নির্ণয়, সীমান্তে চোরাচালান, রোহিঙ্গা সমস্যা দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিন সম্পর্কের ক্ষেত্রে টানাপড়েন সৃষ্টি করেছিল। বর্তমানে দুই দেশের সীমান্ত সমস্যা তেমন উল্লেখ করার মতো নেই। দুই দেশের সমঝোতার ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক আদালতে সমুদ্রসীমার হিস্যা নির্ধারিত হয়ে গেছে। ইদানীং চোরাচালানও নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে। একমাত্র রোহিঙ্গা সমস্যাই দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নে প্রধান বাধা। তাই রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে দুদেশের খুব বেশি আন্তরিক হওয়া জরুরি। আর বাংলাদেশ যদি সমস্যা সমাধানে কূটনৈতিকভাবে ব্যর্থ হয় তাহলে সারাজীবন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ভার বয়ে বেড়াতে হবে।