Sunday, 14 August 2016

আলাওল

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের বহুমুখী প্রতিভায় গুণান্বিত সৈয়দ আলাওল সাহিত্যজগতে এক নবযুগের সৃষ্টিকারী। কবি আলাওলের কাব্য সাধনা ছিল মূলত অনুবাদমূলক। কিন্তু একজন অনুবাদক হয়েও সৃষ্টিশীল লেখনী ও মৌলিকত্বের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে তিনি নতুন প্রাণের জন্ম দিয়েছেন। সতীময়না-লোরচন্দ্রানী, সপ্তপয়কর, সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামান, সেকন্দরনামা, নীতিকাব্য তোহফা প্রভৃতি রচনায় তাঁর সাহিত্য প্রতিভা স্ফুটিত হয়েছে। তিনি ফরাসি ভাষা হতে ‘সেকন্দরনামা’ ও ‘সপ্তপয়কর’ নামক দুটো কাব্য এবং ‘তোহফা’ ধর্মপুস্তকের অনুবাদ করেন। এসব অনুবাদ ব্যতীত কবি দৌলত কাজীর অসমাপ্ত ‘সতীময়না ও লোরচন্দ্রানী’ কাব্যের পরিসমাপ্তি করেন। ফরাসি পুস্তক অবলম্বনে ‘সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামাল’ নামক কাব্য রচনা করেন। বাংলা কাব্যকে তিনি অন্য প্রাদেশিক এবং মধ্যপ্রাচ্যের কাব্যধারার সঙ্গে সংযোজন করে এক নতুন মাত্রার সূত্রপাত করেছিলেন। মধ্যযুগের ধর্মসংস্কারমুক্ত মানবীয় প্রণয়কাহিনী অবলম্বনে কাব্য রচনা করে তিনি প্রথম ধর্মনিরপেক্ষ সাহিত্য রচনা শুরু করেন। একজন বাঙালি কবি হিসেবে তাঁর কাব্যে শুধু যে নারীর রূপ, বিরহ-বেদনা, প্রণয় প্রভৃতি প্রকাশ পেয়েছে তা নয়। মাতৃভূমির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনাও তাঁর কাব্যে খুঁজে পাওয়া যায়। মানুষের মনের স্বাভাবিক বিকাশ ও জাগতিক জীবনের উদার মহিমার ওপর ভিত্তি করে তিনি যেভাবে সাবলীল বর্ণনায় সাহিত্যের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছেন, সেকালে তার তুলনা তিনি নিজেই।
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের দেদীপ্যমান অত্যুজ্জ্বল নক্ষত্র মহাকবি আলাওলের জন্মস্থান ও জন্মকাল নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বিতর্কের উদ্ভব হলেও কবির স্বরচিত রচনায় এ বিতর্কের অনেকটাই অবসান হয়। কবির জীবনবৃত্তান্ত পদ্মাবতী ও সেকন্দরনামা হতে সংগ্রহ করা যায়।
মুল্লুক ফতেহাবাদ গৌড়তে প্রধান।
তথাতে জালালপুর অতিপূণ্য স্থান
বহু গুণবন্ত বৈসে খলিফা ওলেমা।
কথেক কহিব সেই দেশের মহিমা
মজলিস কুতুব তথাত অধিপতি।
মুই দীন হীন তান অমাত্য সন্ততি
কবির রচিত এ কাব্য অংশটুকু থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে মহাকবি আলাওল ফতেহাবাদ তথা বর্তমানে বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার লোক ছিলেন। আনুমানিক ১৬০৭ খ্রিস্টাব্দে এক অভিজাত মুসলিম পরিবারে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতা ছিলেন ফতেহাবাদের রাজ্যেশ্বর মজলিস কুতুবের একজন মন্ত্রী।
মহাকবির নাম ও নামের বানান নিয়েও পণ্ডিতদের মধ্যে মতবিরোধ লক্ষ করা যায়। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মনে করতেন আলাওলের প্রকৃত নাম ‘আলাউক হক’। ড. মুহম্মদ এনামুল হক মনে করেন তাঁর প্রকৃত নাম সৈয়দ আলাওল। আবার অনেক পণ্ডিত ‘শাহ’ যুক্তও ব্যবহার করেন। বর্তমানে ‘আলাওল’ নামই সর্বজনস্বীকৃত।
আলাওল সম্পর্কে যথার্থ তথ্য না থাকায় প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটন প্রায় অসম্ভব। তার পরও কবির রচিত গ্রন্থাবলি থেকে আগ্রহী সাহিত্যপ্রেমীদের নানাবিধ প্রশ্নের উত্তর মেলে। মহাকবি নিজের আত্মপরিচয় সম্পর্কে বলেছেন,
“রাজ্যেশ্বর মজলিস কুতুব মহাশয়।
আমি ক্ষুদ্রমতি তান অমাত্য তনয়
কার্যহেতু পন্থক্রমে আছে কর্ম লেখা।
দুষ্ট হারমাদ সঙ্গে হই গেল দেখা
বহু যুদ্ধ করিয়া শহীদ হৈল বাপ।
রণক্ষতে রোসাঙ্গে আইল মহাপাপ
আলাওলের পিতা ফতেহাবাদের রাজ্যেশ্বর মজলিস কুতুবের মন্ত্রী ছিলেন। একবার পিতার সঙ্গে নৌকাযোগে চট্টগ্রাম যাওয়ার সময় পর্তুগিজ জলদস্যুদের দ্বারা তাঁরা আক্রান্ত হন। এ সময়ে পর্তুগিজ জলদস্যুদের হাতে আলাওলের পিতা নিহত হন এবং তাদের সর্বস্ব লুণ্ঠিত হয়। আলাওল আহত হলেও প্রাণে বেঁচে যান। এরপর ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের শিকার হয়ে দীর্ঘপথ অতিক্রম করে আরাকানে (বার্মা) এসে উপস্থিত হন। জীবন ও জীবিকার তাগিদে এখানে তিনি একজন দেহরক্ষী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। শুরু হয় পরদেশে কবির নতুন জীবন-সংগ্রাম। এর কিছুদিনের ব্যবধানেই আলাওল মহন্তের গৃহে নাটগীত ও  সংগীত শিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেন। অল্প কিছু দিনের মধ্যে একজন সংগীতবিদ হিসেবে তাঁর খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এ খ্যাতির বদৌলতে সমাজের উচ্চ শ্রেণীর ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠার সুযোগ হয়। ক্রমেই আলাওলের উচ্চমার্গের কলাজ্ঞান, বিদ্যা-বুদ্ধির ও কবি প্রতিভার কথা অভিজাত সমাজে ছডিয়ে পড়তে থাকে। এ সুবাদে তিনি আরাকানের প্রধানমন্ত্রী বহুশাস্ত্রবিদ কবি কোরেশী মাগন ঠাকুরের কাছে আশ্রয় লাভের সুযোগ পান। তত্কালীন সময়ে আরাকান রাজসভায় চমত্কার এক সাহিত্যিক পরিবেশ বিরাজ করছিল। মূলত কোরেশী মাগন ঠাকুর কাছে আশ্রয় লাভের সময় থেকেই আলাওল কাব্য সাধনায় নিজেকে সম্পূর্ণরূপে আত্মনিয়োগ করেন। এ সময় একের পর এক তাঁর কবি প্রতিভার স্ফুটন ঘটতে থাকে এবং সাধারণ আলাওল থেকে তিনি হয়ে ওঠেন আজকের মহাকবি আলাওল।
আলাওল মধ্যযুগের সর্বাধিক গ্রন্থপ্রণেতা বাঙালি মুসলিম কবি। তাঁর মোট কাব্য সংখ্যা সাত। বাংলা সাহিত্যের মৌলিকত্ব, কাহিনী রূপায়ণ, চরিত্র নির্মাণ এবং প্রকাশভঙ্গির ক্ষেত্রে তিনি এক বৈচিত্র্যপূর্ণ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। ‘সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামাল’ প্রেমমূলক কাহিনী কাব্য। এ কাব্যে রাজপুত্র সয়ফুলমুুলুক ও পরীরাজ কন্যা বদিউজ্জামালের মধ্যকার প্রণয় বৃত্তান্ত বর্ণিত হয়েছে। সতীময়না-লোরচন্দ্রানী দৌলত কাজীর অসমাপ্ত কাব্য আমত্য সুলায়মানের অনুরোধে ১৬৫৯ সালে তিনি এটা সমাপ্ত করেন। এ কাব্যে রানী ময়নামতী, রাজা লোর ও রাজকন্যা চন্দ্রানীর প্রেমবৃত্তান্ত সুন্দর ও সাবলীলভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। পারস্যরাজ বাহরাম ও তাঁর সাত রানীর গল্প কবির রচিত সপ্তপয়কর গ্রন্থের বর্ণনীয় বিষয়। নীতিবাক্য তোহফা কাব্যে কবি নিজের বার্ধক্যের কথা বলে আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন। গ্রিকরাজ সেকন্দর বা আলেকজান্ডারের এবং পারস্যরাজ দারাউসের যুদ্ধের বৃত্তান্ত এবং সেকান্দরের দিগ্বিজয় বর্ণিত আছে কবির রচিত সেকন্দরনামা নামক সর্বশেষ গ্রন্থে। এ কাব্যে সুফিভাবের কবিতাও দেখা যায়:
‘আইস গুরু প্রেম সুরা দেও মোরে ভরি।/যার পানে মিত্র লাভ আপনা পসারি’
তবে পদ্মাবতী কাব্যটি সৈয়দ আলাওলের সর্বপ্রণিধান্য সাহিত্যকর্ম। ১৬৪৮ খ্রিস্টাব্দে আরাকান প্রধানমন্ত্রী মাগন ঠাকুরের অনুরোধে মালিক মুহাম্মদ জায়সীর হিন্দি পদুসাবত হতে প্রায় তিন বছর ধরে তিনি এর অনুবাদ করেন। পদ্মাবতী দুটি পর্বে বিভক্ত। প্রথম পর্বে সিংহলের রাজকন্যা পদ্মাবতীকে লাভ করার জন্য চিতোররাজ রত্নসেনের সফল অভিযান এবং দ্বিতীয? পর্বে রাণী পদ্মাবতীকে লাভ করার জন্য দিল্লির সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির ব্যর্থ সামরিক অভিযানের বিবরণ আছে। অনুবাদধর্মী হলেও পদ্মাবতীর ভাষা, নাগরিক রুচি-শিক্ষা, সংস্কৃতি, মানবিকতা অনন্যসাধারণ হয়ে ফুটে উঠেছে সর্বত্র। ফলে সাহিত্যপ্রেমীদের কাছে মৌলিকতার মর্যাদায় আজো সমাসীন। মূলত এই শিল্পকর্মের ভাষাজ্ঞান ও পাণ্ডিত্য সৈয়দ আলাওলকে মহাকবির মর্যাদায় আসীন করে।
মধ্যযুগের বাঙালি কবিদের মধ্যে আলাওলের স্থান অতি ঊর্ধ্বে। আরবি, ফারসি, সংস্কৃত, ব্রজবুলি ও হিন্দি ভাষাতে তিনি পারদর্শী ছিলেন। তাঁর রচনা থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় তিনি যোগশাস্ত্র, সংগীতবিদ্যা প্রভৃতি বিষয়েও অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। পাঠকের উদ্দেশে তাঁর রচিত একটা সংস্কৃত শ্লোক এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে।
‘মূর্খানাং প্রতিমা দেবো বিপ্রদেবো হুতাশনঃ।/যোগীনাং প্রার্থনা দেবো দেবদেবো নিরঞ্জন
কবি স্বয়ং এর অনুবাদ করেছেন—
‘মূর্খ সকলের দেব প্রতিমা সে সার,/ব্রাহ্মণ সবের দেব অগ্নি অবতার।/যোগী সকলের দেব আপ্ত মহাজন/সকল দেবের দেব প্রভু নিরঞ্জন’
মহাকবি আলাওল ছিলেন ভাগ্যবিড়ম্বিত এক কবি। সারা জীবন নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে কেটেছে। রাজপরিবারের সন্তান হয়েও নিরবিচ্ছন্ন সুখের সাগরে নিজেকে ভাসিয়ে রাখতে পারেননি। ছোটবেলা পিতাকে হারিয়ে অনিশ্চিত জীবনের যে যাত্রা শুরু করেছিলেন, বলতে গেলে জীবনের শেষ অবধি তা অব্যাহত ছিল। ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে কারারুদ্ধ হয়েছেন। নানা বিদ্যায় বিশারদ মহাকবি আলাওল জীবনের পড়ন্তবেলা আধ্যাত্মিক মার্গতায় চলে গিয়েছিলেন। আলাওলের কাব্যে আত্মপরিচয়ে শেষ জীবনে ভিক্ষা করে বাঁচার ঘটনা আমাদের ব্যথিত করে।

Saturday, 13 August 2016

বন্যায় আক্রান্ত জনপদ

ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশ প্রায় প্রতি বছরই বন্যাকবলিত হয়। এবারো এর ব্যতিক্রম হয়নি। অতিবৃষ্টির ফলে নদীর পানি উপচে লোকালয়ে প্রবেশ করে বন্যার সৃষ্টি করে। তবে অনেকের মতে, এবারের সৃষ্ট বন্যার কারণ ভিন্ন। ভারতের উজানের পানি ও পাহাড়ি ঢল এবারের বন্যার জন্য দায়ী। কারণ যা-ই হোক না কেন, দেশের বিভিন্ন জেলা বন্যাকবলিত হয়ে অসংখ্য মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এরই মধ্যে। বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে আরো নতুন জেলা কবলিত হবে। বন্যায় বিশেষ করে দেশের উপকূলীয় ও নিম্নাঞ্চল বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়া ও সিরাজগঞ্জ জেলাগুলোর নিম্নাঞ্চল এবং গঙ্গা-পদ্মা নদীসংলগ্ন রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ ও শরীয়তপুর জেলাগুলোর বেশকিছু নিম্নাঞ্চল এখন বন্যাকবলিত। নদী-নালা, খাল-বিল প্লাবিত হয়ে বন্যার পানি উপচে পড়ছে সমতল ভূমিতে। রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, স্কুল-কলেজ সবই অথৈ জলে ভাসছে। দেশের লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। বন্যার কারণে এরই মধ্যে অসংখ্য পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়েছে। নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে অনেকের বসতবাড়ি। কৃষকের ফসলি জমি নষ্ট হয়েছে। বানের জলে ভাসছে সাধারণ মানুষের নিয়তি। এসব বানভাসি মানুষের মানবেতর জীবনের গল্প গণমাধ্যমে সচিত্র প্রতিবেদনসহ প্রকাশিত হচ্ছে। এসব দুর্গত মানুষের দুর্ভোগের কথা লিখে বোঝানো যায় না। হূদয় দিয়ে অনুভব করতে হয়।
নামমাত্র যে ত্রাণসামগ্রী দেয়া হচ্ছে, তাও বন্যার্তদের অনেকেই পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ। বানভাসি একজন মানুষও যেন খাদ্যাভাবে, সাহায্যের অভাবে, চিকিত্সার অভাবে যেন মারা না যায়— সেদিকে আমাদের লক্ষ্য রাখা উচিত। বন্যার্ত মানুষের জন্য পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী ও চিকিত্সার ব্যবস্থা করা মানবিক দায়িত্ব। তাদের প্রতি সবার সদয় হতে হবে। এখন বন্যা পরিস্থিতির অনেকটাই উন্নতি হয়েছে। কিন্তু দেখা দিয়েছে নতুন সমস্যা। এসব অঞ্চলের অনেকেই পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের অভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন অনেকে। দুর্ভোগের পাশাপাশি অর্থনৈতিক ক্ষতি তো আছেই। ঘরবাড়ি, গৃহপালিত পশু, ফসলি জমি, মাছের ঘের, বীজতলা প্রভৃতি নষ্ট হয়েছে। ফলে বন্যায় বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।
বাংলাদেশে বন্যা একটি স্বাভাবিক ঘটনা। এ সমস্যা সমাধানে তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ চোখে পড়ে না। বন্যার ক্ষতি ও প্রতিকূল প্রভাব হ্রাস করতে এবং অতিরিক্ত পানি সেচকার্যে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কিছু বাঁধ নির্মাণ ও খাল খনন করেছে। কিন্তু সেগুলো যে পর্যাপ্ত নয়, তা বন্যাক্রান্ত হলেই বোঝা যায়। এছাড়া বন্যা নিয়ন্ত্রণে শুধু কাঠামোগত উন্নয়ন হলেই হবে না, অবকাঠামোগত নানা উন্নয়নও অপরিহার্য।
বন্যা একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলেও সম্মিলিতভাবে তা মোকাবেলা করা অসম্ভব নয়। বন্যাকবলিত মানুষের সাহায্যার্থে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও সমাজের বিত্তশালী মানুষের এগিয়ে আসতে হবে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী ও চিকিত্সা সরবরাহ করতে হবে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের ব্যাংকঋণ মওকুফের পাশাপাশি চাষাবাদের জন্য প্রয়োজনীয় কৃষিপণ্য বিনামূল্যে সরবরাহ করতে হবে। রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রভৃতি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নির্মাণ করতে হবে।


Tuesday, 2 August 2016

ভেজাল ওষুধ, নাকাল ভোক্তা

ওষুধ যদি ভেজাল ও নিম্নমানের হয়, তাহলে পাঠক ভাবুন তো কী ভয়ঙ্কর অবস্থা হতে পারে? ভাবলেই ভয়ে গা শিউরে ওঠে। দেশে এখন সবকিছুতেই ভেজাল। বলতে গেলে এ যেন এক ভেজালের রাজত্বে আমাদের বসবাস! মানুষের নীতি-নৈতিকতার স্খলন হচ্ছে। নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য বৃহত্ অন্যায় কাজ করতেও মানুষ এখন পিছপা হচ্ছে না। অসাধু ব্যবসায়ী শুধু ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘন করছে না, জনস্বাস্থ্য হুমকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। দেশের প্রতিষ্ঠিত নামি-দামি কোম্পানির ওষুধ ব্যাপক হারে নকল হচ্ছে; বিশেষ করে যে ওষুধগুলোর বাজারে কাটতি বেশি। অধিক মুনাফার লোভে একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী এসব ওষুধ নকল করেন। নকল ওষুধের মোড়ক ও আসল ওষুধের মোড়ক দেখতেও প্রায় একই রকম। শিক্ষিত মানুষের পক্ষে দুইয়ের পার্থক্য খুঁজে বের করে আসলটা কেনা বেশ কষ্টসাধ্য। শিক্ষাহীন মানুষের পক্ষে তো একেবারেই অসম্ভব। সবচেয়ে বড় বিষয়, দেশের অধিকাংশ মানুষের ওষুধ সম্পর্কে জ্ঞান বলতে গেলে একদম শূন্যের কোটায়। অসাধু ব্যবসায়ী শ্রেণী এ সুযোগেরই সুবিধা নিচ্ছে। আর আমজনতা নকল ও ভেজাল ওষুধ কিনে প্রতারিত হচ্ছে। শহরের তুলনায় গ্রাম ও মফস্বল শহরে নকল ও ভেজাল ওষুধ বেশি বিক্রি হয়। গ্রামের সহজ-সরল, অর্ধশিক্ষিত ও অশিক্ষিত মানুষের সরলতার সুযোগ নিয়ে ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ কোম্পানিগুলো তাদের ব্যবসার ক্ষেত্রকে গ্রাম ও মফস্বল শহরে সম্প্রসারণ করছে। কিছু গ্রাম্য হাতুড়ে ডাক্তার তাদের এ জনস্বার্থবিরোধী কাজ বিস্তারে সহযোগিতা করছেন। কোম্পানির কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের আর্থিক সুবিধাপ্রাপ্তির বিনিময়ে তারা ওইসব কোম্পানির নিম্নমানের ওষুধ রোগীদের প্রেসক্রাইব করেন। রোগী নিরুপায় হয়ে ওইসব ওষুধ সেবন করতে বাধ্য হন।
সম্প্রতি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ১৯৭৬ সালের জিএমপি (গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিস) নীতিমালা অনুসরণ করে মানসম্পন্ন উপায়ে ওষুধ প্রস্তুত না করাসহ আরো বেশকিছু কারণে দেশের ২০টি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিলসহ ৫৪টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন রকম শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছে। এখন এ সুপারিশ কতটুকু বাস্তবে কার্যকর হয়, তা দেখার অপেক্ষা। ওষুধ কারখানার উত্পাদিত ওষুধের মান নিয়ে আমরা বিভিন্ন সময় পত্র-পত্রিকায় অনুসন্ধানী প্রতিবেদন দেখি। সেখানে ওষুধ শিল্পের নৈরাজ্য নিয়ে ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরা হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, মিডিয়ায় বিভিন্ন অভিযোগ তুলে ধরে প্রতিবেদন প্রকাশ হলেও কর্তৃপক্ষ তেমন কার্যকর ব্যবস্থা নেয় না। অনেক সময় দেখা যায়, প্রশাসনের নাকের ডগায় বিক্রি হয় ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ। খোদ রাজধানীর ফুটপাত দিয়ে চলার সময় বিভিন্ন মোড়ে ভেষজ ওষুধের নামে বিভিন্ন ধরনের ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ বিক্রি চোখে পড়ে। এসব ওষুধপত্র উপকারে তো আসেই না, বরং জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। মাঝে মধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়। তবে তা যথেষ্ট নয়। এছাড়া বেশির ভাগ সময় অভিযানগুলো পরিচালিত হয় ওষুধের দোকানগুলোয়। কিন্তু আদৌ এর কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। কারণ ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ তো দোকানদার উত্পাদন করে না, উত্পাদন করে কোনো না কোনো অবৈধ ওষুধ কোম্পানি। তাই ভেজাল ওষুধ রোধে সবার আগে ভেজাল ওষুধ উত্পাদনকারী প্রতিষ্ঠান চিরতরে বন্ধ করতে হবে। এছাড়া অভিযানগুলো সীমিত পরিসরে পরিচালিত না করে গ্রাম ও মফস্বল শহরেও ছড়িয়ে দিতে হবে। গ্রাম্য ডাক্তারদের বিষয়েও সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা দরকার, যাতে মানুষের জীবন নিয়ে তারা ছেলেখেলা করতে না পারে।

এ শিক্ষা আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?

সাত সকালে পূর্বাকাশে সূর্যিমামা উঁকি দেয়ার অনেক আগেই মহানগরীর কর্মব্যস্ততা শুরু হয়ে যায়। বৈদ্যুতিক তারের উপর বসে থাকা কাকগুলো প্রথমবার কা’ করে ওঠার আগেই শশব্যস্ত মায়েরা বইপত্রের পসরা সাজিয়ে বের হয়ে পড়েন সন্তানকে নিয়ে। লক্ষ্য ঘুম ঢুলুঢুলু চোখে ঝিমুতে থাকা সন্তানটিকে সময়মত স্কুলে রেখে আসা। ব্যস্ত নগরীর এটা প্রতিদিনের রুটিন। এছাড়া সন্তানকে স্কুল-কলেজে ভর্তি করানো তো আছে, সঙ্গে যুক্ত হয় প্রাইভেট কিংবা কোচিং-এর বাড়তি চাপ। যদি প্রশ্ন করা হয় মায়েরা এমন অমানবিক ক্লান্তহীন পরিশ্রম কেন করছেন, বাবারা তাদের রক্ত জল করা শ্রমে আয়করা অর্থ কিসের পেছনে ব্যয় করছেন? সব প্রশ্নের সহজ উত্তর সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যত্ নিশ্চিত করা। কিন্তু পরক্ষণেই যদি প্রশ্ন করা যায় এ ভবিষ্যত্ কি শুধুই পরীক্ষার ভালো ফল অর্জনের ওপর নির্ভরশীল? তখন অনেকই নীরব হয়ে যেতে বাধ্য। তারপর কেউ কেউ মুখ ফসকে বলেও দিতে পারেন এটা আমার ছেলে-মেয়ের এ প্লাস পাওয়ার জন্য। কেউ যদি প্রশ্ন করেন এ প্লাস পেলে কী হবে? যদি এ প্লাস না পায় তবে কী হবে? এক্ষেত্রে মা-বাবার ঢালাও বিশ্বাস এ প্লাস প্রাপ্তি সোনালী ভবিষ্যতের হাতছানি, আর এ প্লাস প্রাপ্তির ব্যর্থতা মূর্তিমান এক ধ্বংসস্তূপের হাতছানি। বাস্তবে সন্তানদের এমন অসহনীয় পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় যাচাইয়ের মূল মানদণ্ড ভালো ফলাফল হয়ে যাওয়াতে। এখানে প্রতিটি শিক্ষার্থীর জীবন কোনো কল-কারখানার যন্ত্রাংশ থেকে ভিন্ন কিছু নয়। সবাই এখানে দৌড়াচ্ছে ভালো ফলের পেছনে, ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত শিশুরা ভয়ে কেউ কেউ জীবন থেকে ছুটি নিয়ে ফেলছে বিরক্তি ভরে। তারপরও মা-বাবার প্রত্যাশার কমতি নেই। সমাজ তাদের কী দায়িত্ব দিয়েছে, মানুষ হতে গেলে কী করতে হবে পাশাপাশি আরো নানা বিষয় নিয়ে তাদের চিন্তার সুযোগ কোথায়? তাদের দৌড় এক ভালো ফলাফলের পেছনে আর এটা করতে গেলে পেতে হবে অনেক নম্বর। প্রয়োজনে গোপনে বের করে আনতে হবে প্রশ্নপত্র। তারপর মুখস্থ করে, অন্যেরটা দেখে উত্তরপত্রে ঢেলে দিলেই কেল্লা ফতে। নীতি-নৈতিকতার এখানে কোনো স্থান নেই। আর এভাবে চলতে গিয়ে বাস্তবে এক খাদের কিনারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা।
বেশ কিছুদিন আগে দেশের ‘শিক্ষা ব্যবস্থার মান’ নিয়ে প্রশ্ন তুলে একটি বেসরকারি টেলিভিশনে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটি প্রকাশের পরই এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুরু হয় তর্ক-বির্তক। প্রতিবেদক জিপিএ-৫ পাওয়া ১৩ জন শিক্ষার্থীকে কিছু প্রশ্ন করার মাধ্যমে বর্তমান শিক্ষার ব্যবস্থার সার্বিক চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। প্রতিবেদক এবং প্রতিবেদনটি নিয়ে তর্ক-বির্তক থাকলেও মনে করি প্রতিবেদনে ফুটে উঠা শিক্ষার করুণ দশা সম্পর্কে সচেতন মহলে বির্তক নেই। জিপিএ এবং এসএসসি-এর পূর্ণাঙ্গ রূপ কী, শহীদ মিনার ও স্মৃতিসৌধের অবস্থান কোথায়, অপারেশন সার্চ লাইট কী, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস কবে, স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবস কবে, মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশকে কয়টি সেক্টরে ভাগ করা হয়েছিল— প্রতিবেদকের এমন অতি সাধারণ প্রশ্নে জিপিএ-৫ পাওয়া ১৩ জন শিক্ষার্থী যে উত্তর দিয়েছেন তা খুবই হতাশাজনক। যদিও  লক্ষাধিক শিক্ষার্থীর অর্জন মাত্র ১৩ জন শিক্ষার্থী দিয়ে বিচার করা যায় না। তবে ঐ ১৩ জন যে উত্তর দিয়েছে তা আর কিছু নয়, জাতির হতাশার প্রহর দীর্ঘায়িত হওয়ার স্পষ্ট ইঙ্গিত বটে।
শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশ ও সৃজনশীল হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে সরকার ২০০৮ সালে উন্নত বিশ্বের প্রশ্নপত্রের ধারণায় সনাতন প্রশ্ন পদ্ধতি বাদ দিয়ে দেশে শিক্ষা ব্যবস্থায় সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি চালু করে। প্রথম বছর পরীক্ষামূলকভাবে সাধারণ শিক্ষায় এসএসসি পর্যায়ে এটা চালু করা হয়। পরে তা মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষায়ও প্রয়োগ করা হয়। এছাড়াও শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশের জন্য সরকার আইন করে প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তকের নোট বই মুদ্রণ, বাঁধাই, প্রকাশনা, আমদানি, বিতরণ ও বিক্রি নিষিদ্ধ করে। উচ্চ আদালতের এক রায়ে গাইড ও নোট বই মুদ্রণ ও বাজারজাত সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়। গৃহীত এ সকল পদক্ষেপ যুগোপযোগী এবং প্রশংসনীয়ও বটে। তবে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে— নোট বা গাইড বই মুদ্রণ ও বাজারজাত নিষিদ্ধ করা হলেও বইয়ের দোকানগুলোতে অনেকটা প্রকাশ্যেই নোট বা গাইড বই বিক্রি করা হয়।
তাছাড়া পরীক্ষায় নোট বা গাইড থেকে প্রশ্ন করা হলে শিক্ষার্থীরা পাঠ্য বইয়ের উপর আগ্রহ হারিয়ে নোট বা গাইডের উপর নির্ভরশীল হবে। জাতির জন্য যা হবে অপূরণীয় ক্ষতি। শিক্ষার্থীদের মেধার বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে, বিফলে যাবে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য। জাতির বৃহত্তর স্বার্থে জাতির মেরুদণ্ড শিক্ষাখাত নিয়ে কোনোভাবেই ছেলেখেলা করা যাবে না।