মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের বহুমুখী প্রতিভায় গুণান্বিত সৈয়দ আলাওল
সাহিত্যজগতে এক নবযুগের সৃষ্টিকারী। কবি আলাওলের কাব্য সাধনা ছিল মূলত
অনুবাদমূলক। কিন্তু একজন অনুবাদক হয়েও সৃষ্টিশীল লেখনী ও মৌলিকত্বের
মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে তিনি নতুন প্রাণের জন্ম দিয়েছেন।
সতীময়না-লোরচন্দ্রানী, সপ্তপয়কর, সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামান, সেকন্দরনামা,
নীতিকাব্য তোহফা প্রভৃতি রচনায় তাঁর সাহিত্য প্রতিভা স্ফুটিত হয়েছে। তিনি
ফরাসি ভাষা হতে ‘সেকন্দরনামা’ ও ‘সপ্তপয়কর’ নামক দুটো কাব্য এবং ‘তোহফা’
ধর্মপুস্তকের অনুবাদ করেন। এসব অনুবাদ ব্যতীত কবি দৌলত কাজীর অসমাপ্ত
‘সতীময়না ও লোরচন্দ্রানী’ কাব্যের পরিসমাপ্তি করেন। ফরাসি পুস্তক অবলম্বনে
‘সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামাল’ নামক কাব্য রচনা করেন। বাংলা কাব্যকে তিনি অন্য
প্রাদেশিক এবং মধ্যপ্রাচ্যের কাব্যধারার সঙ্গে সংযোজন করে এক নতুন মাত্রার
সূত্রপাত করেছিলেন। মধ্যযুগের ধর্মসংস্কারমুক্ত মানবীয় প্রণয়কাহিনী
অবলম্বনে কাব্য রচনা করে তিনি প্রথম ধর্মনিরপেক্ষ সাহিত্য রচনা শুরু করেন।
একজন বাঙালি কবি হিসেবে তাঁর কাব্যে শুধু যে নারীর রূপ, বিরহ-বেদনা, প্রণয়
প্রভৃতি প্রকাশ পেয়েছে তা নয়। মাতৃভূমির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনাও তাঁর
কাব্যে খুঁজে পাওয়া যায়। মানুষের মনের স্বাভাবিক বিকাশ ও জাগতিক জীবনের
উদার মহিমার ওপর ভিত্তি করে তিনি যেভাবে সাবলীল বর্ণনায় সাহিত্যের ভিত্তি
প্রতিষ্ঠা করেছেন, সেকালে তার তুলনা তিনি নিজেই।
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের দেদীপ্যমান অত্যুজ্জ্বল নক্ষত্র মহাকবি
আলাওলের জন্মস্থান ও জন্মকাল নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বিতর্কের উদ্ভব হলেও
কবির স্বরচিত রচনায় এ বিতর্কের অনেকটাই অবসান হয়। কবির জীবনবৃত্তান্ত
পদ্মাবতী ও সেকন্দরনামা হতে সংগ্রহ করা যায়।
মুল্লুক ফতেহাবাদ গৌড়তে প্রধান।
তথাতে জালালপুর অতিপূণ্য স্থান
বহু গুণবন্ত বৈসে খলিফা ওলেমা।
কথেক কহিব সেই দেশের মহিমা
মজলিস কুতুব তথাত অধিপতি।
মুই দীন হীন তান অমাত্য সন্ততি
কবির রচিত এ কাব্য অংশটুকু থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে মহাকবি আলাওল
ফতেহাবাদ তথা বর্তমানে বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার লোক ছিলেন। আনুমানিক ১৬০৭
খ্রিস্টাব্দে এক অভিজাত মুসলিম পরিবারে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতা ছিলেন
ফতেহাবাদের রাজ্যেশ্বর মজলিস কুতুবের একজন মন্ত্রী।
মহাকবির নাম ও নামের বানান নিয়েও পণ্ডিতদের মধ্যে মতবিরোধ লক্ষ করা যায়।
আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মনে করতেন আলাওলের প্রকৃত নাম ‘আলাউক হক’। ড.
মুহম্মদ এনামুল হক মনে করেন তাঁর প্রকৃত নাম সৈয়দ আলাওল। আবার অনেক পণ্ডিত
‘শাহ’ যুক্তও ব্যবহার করেন। বর্তমানে ‘আলাওল’ নামই সর্বজনস্বীকৃত।
আলাওল সম্পর্কে যথার্থ তথ্য না থাকায় প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটন প্রায় অসম্ভব।
তার পরও কবির রচিত গ্রন্থাবলি থেকে আগ্রহী সাহিত্যপ্রেমীদের নানাবিধ
প্রশ্নের উত্তর মেলে। মহাকবি নিজের আত্মপরিচয় সম্পর্কে বলেছেন,
“রাজ্যেশ্বর মজলিস কুতুব মহাশয়।
আমি ক্ষুদ্রমতি তান অমাত্য তনয়
কার্যহেতু পন্থক্রমে আছে কর্ম লেখা।
দুষ্ট হারমাদ সঙ্গে হই গেল দেখা
বহু যুদ্ধ করিয়া শহীদ হৈল বাপ।
রণক্ষতে রোসাঙ্গে আইল মহাপাপ
আলাওলের পিতা ফতেহাবাদের রাজ্যেশ্বর মজলিস কুতুবের মন্ত্রী ছিলেন। একবার
পিতার সঙ্গে নৌকাযোগে চট্টগ্রাম যাওয়ার সময় পর্তুগিজ জলদস্যুদের দ্বারা
তাঁরা আক্রান্ত হন। এ সময়ে পর্তুগিজ জলদস্যুদের হাতে আলাওলের পিতা নিহত হন
এবং তাদের সর্বস্ব লুণ্ঠিত হয়। আলাওল আহত হলেও প্রাণে বেঁচে যান। এরপর
ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের শিকার হয়ে দীর্ঘপথ অতিক্রম করে আরাকানে (বার্মা)
এসে উপস্থিত হন। জীবন ও জীবিকার তাগিদে এখানে তিনি একজন দেহরক্ষী হিসেবে
কর্মজীবন শুরু করেন। শুরু হয় পরদেশে কবির নতুন জীবন-সংগ্রাম। এর কিছুদিনের
ব্যবধানেই আলাওল মহন্তের গৃহে নাটগীত ও সংগীত শিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু
করেন। অল্প কিছু দিনের মধ্যে একজন সংগীতবিদ হিসেবে তাঁর খ্যাতি চারদিকে
ছড়িয়ে পড়ে। এ খ্যাতির বদৌলতে সমাজের উচ্চ শ্রেণীর ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে তাঁর
ঘনিষ্ঠার সুযোগ হয়। ক্রমেই আলাওলের উচ্চমার্গের কলাজ্ঞান, বিদ্যা-বুদ্ধির ও
কবি প্রতিভার কথা অভিজাত সমাজে ছডিয়ে পড়তে থাকে। এ সুবাদে তিনি আরাকানের
প্রধানমন্ত্রী বহুশাস্ত্রবিদ কবি কোরেশী মাগন ঠাকুরের কাছে আশ্রয় লাভের
সুযোগ পান। তত্কালীন সময়ে আরাকান রাজসভায় চমত্কার এক সাহিত্যিক পরিবেশ
বিরাজ করছিল। মূলত কোরেশী মাগন ঠাকুর কাছে আশ্রয় লাভের সময় থেকেই আলাওল
কাব্য সাধনায় নিজেকে সম্পূর্ণরূপে আত্মনিয়োগ করেন। এ সময় একের পর এক তাঁর
কবি প্রতিভার স্ফুটন ঘটতে থাকে এবং সাধারণ আলাওল থেকে তিনি হয়ে ওঠেন আজকের
মহাকবি আলাওল।
আলাওল মধ্যযুগের সর্বাধিক গ্রন্থপ্রণেতা বাঙালি মুসলিম কবি। তাঁর মোট
কাব্য সংখ্যা সাত। বাংলা সাহিত্যের মৌলিকত্ব, কাহিনী রূপায়ণ, চরিত্র
নির্মাণ এবং প্রকাশভঙ্গির ক্ষেত্রে তিনি এক বৈচিত্র্যপূর্ণ দক্ষতার পরিচয়
দিয়েছেন। ‘সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামাল’ প্রেমমূলক কাহিনী কাব্য। এ কাব্যে
রাজপুত্র সয়ফুলমুুলুক ও পরীরাজ কন্যা বদিউজ্জামালের মধ্যকার প্রণয়
বৃত্তান্ত বর্ণিত হয়েছে। সতীময়না-লোরচন্দ্রানী দৌলত কাজীর অসমাপ্ত কাব্য
আমত্য সুলায়মানের অনুরোধে ১৬৫৯ সালে তিনি এটা সমাপ্ত করেন। এ কাব্যে রানী
ময়নামতী, রাজা লোর ও রাজকন্যা চন্দ্রানীর প্রেমবৃত্তান্ত সুন্দর ও
সাবলীলভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। পারস্যরাজ বাহরাম ও তাঁর সাত রানীর গল্প কবির
রচিত সপ্তপয়কর গ্রন্থের বর্ণনীয় বিষয়। নীতিবাক্য তোহফা কাব্যে কবি নিজের
বার্ধক্যের কথা বলে আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন। গ্রিকরাজ সেকন্দর বা
আলেকজান্ডারের এবং পারস্যরাজ দারাউসের যুদ্ধের বৃত্তান্ত এবং সেকান্দরের
দিগ্বিজয় বর্ণিত আছে কবির রচিত সেকন্দরনামা নামক সর্বশেষ গ্রন্থে। এ কাব্যে
সুফিভাবের কবিতাও দেখা যায়:
‘আইস গুরু প্রেম সুরা দেও মোরে ভরি।/যার পানে মিত্র লাভ আপনা পসারি’
তবে পদ্মাবতী কাব্যটি সৈয়দ আলাওলের সর্বপ্রণিধান্য সাহিত্যকর্ম। ১৬৪৮
খ্রিস্টাব্দে আরাকান প্রধানমন্ত্রী মাগন ঠাকুরের অনুরোধে মালিক মুহাম্মদ
জায়সীর হিন্দি পদুসাবত হতে প্রায় তিন বছর ধরে তিনি এর অনুবাদ করেন।
পদ্মাবতী দুটি পর্বে বিভক্ত। প্রথম পর্বে সিংহলের রাজকন্যা পদ্মাবতীকে লাভ
করার জন্য চিতোররাজ রত্নসেনের সফল অভিযান এবং দ্বিতীয? পর্বে রাণী
পদ্মাবতীকে লাভ করার জন্য দিল্লির সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির ব্যর্থ সামরিক
অভিযানের বিবরণ আছে। অনুবাদধর্মী হলেও পদ্মাবতীর ভাষা, নাগরিক রুচি-শিক্ষা,
সংস্কৃতি, মানবিকতা অনন্যসাধারণ হয়ে ফুটে উঠেছে সর্বত্র। ফলে
সাহিত্যপ্রেমীদের কাছে মৌলিকতার মর্যাদায় আজো সমাসীন। মূলত এই শিল্পকর্মের
ভাষাজ্ঞান ও পাণ্ডিত্য সৈয়দ আলাওলকে মহাকবির মর্যাদায় আসীন করে।
মধ্যযুগের বাঙালি কবিদের মধ্যে আলাওলের স্থান অতি ঊর্ধ্বে। আরবি, ফারসি,
সংস্কৃত, ব্রজবুলি ও হিন্দি ভাষাতে তিনি পারদর্শী ছিলেন। তাঁর রচনা থেকে
প্রমাণ পাওয়া যায় তিনি যোগশাস্ত্র, সংগীতবিদ্যা প্রভৃতি বিষয়েও অগাধ
পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। পাঠকের উদ্দেশে তাঁর রচিত একটা সংস্কৃত শ্লোক
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে।
‘মূর্খানাং প্রতিমা দেবো বিপ্রদেবো হুতাশনঃ।/যোগীনাং প্রার্থনা দেবো দেবদেবো নিরঞ্জন
কবি স্বয়ং এর অনুবাদ করেছেন—
‘মূর্খ সকলের দেব প্রতিমা সে সার,/ব্রাহ্মণ সবের দেব অগ্নি অবতার।/যোগী সকলের দেব আপ্ত মহাজন/সকল দেবের দেব প্রভু নিরঞ্জন’
মহাকবি আলাওল ছিলেন ভাগ্যবিড়ম্বিত এক কবি। সারা জীবন নানা উত্থান-পতনের
মধ্য দিয়ে কেটেছে। রাজপরিবারের সন্তান হয়েও নিরবিচ্ছন্ন সুখের সাগরে নিজেকে
ভাসিয়ে রাখতে পারেননি। ছোটবেলা পিতাকে হারিয়ে অনিশ্চিত জীবনের যে যাত্রা
শুরু করেছিলেন, বলতে গেলে জীবনের শেষ অবধি তা অব্যাহত ছিল। ষড়যন্ত্রের
শিকার হয়ে কারারুদ্ধ হয়েছেন। নানা বিদ্যায় বিশারদ মহাকবি আলাওল জীবনের
পড়ন্তবেলা আধ্যাত্মিক মার্গতায় চলে গিয়েছিলেন। আলাওলের কাব্যে আত্মপরিচয়ে
শেষ জীবনে ভিক্ষা করে বাঁচার ঘটনা আমাদের ব্যথিত করে।