চীনের হুবেই প্রদেশ থেকে ছড়িয়ে পড়া প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে ইতিমধ্যে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে। মহামারি করোনা ভাইরাসের আক্রমনে পুরো মানবজাতি এখন বিপন্ন এবং বিপদগ্রস্ত। এ পর্যন্ত (১৮/০৫/২০২০- ) এই ভয়ংকর ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বিশ্বে ৩,১৭,২০০ জন ব্যক্তি মারা গেছেন এবং ৪৮,৩০,২৯৬ জন ব্যক্তি আক্রান্ত হয়েছেন। মার্চ মাসে বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী সনাক্ত হওয়ার পর থেকে আমাদের দেশেও প্রতিদিন আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটির মেয়াদ কয়েক দফা বাড়িয়ে এখনো চলছে। মানুষের জীবন- জীবিকা বলতে গেলে একপ্রকারে স্থিতাবস্থা। এই ভয়ংকর মহামারির মধ্যে যারা সু-স্বাস্থ্য নিয়ে বেঁচে আছেন, অর্থনৈতিক সংকটে তাদের অধিকাংশের অবস্থাও নাজুক। বিত্তবানরা ঘরবন্দি হয়ে জীবনযাপনে সমর্থ হলেও, সীমিত আয়ের নিম্নবিত্ত, অসহায় ও দুঃস্ত মানুষগুলোর পাশাপাশি মধ্যবিত্তরাও আছেন ভীষণ বিপদে। দীর্ঘদিনের লডডাউনে কর্মহীন অবস্থায় থাকায়, অনেকের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায়, অনেকে অর্ধেক বেতন পাওয়াই কিংবা চাকরিচ্যুত হওয়াই জীবনধারণ করাই এখন তাদের জন্য দিনেদিনে অসম্ভব হয়ে উঠছে। চরম অর্থনৈতিক এই সংকটের মধ্যে নগরবাসীর বাসা ভাড়া, গ্যাস বিল, বিদ্যুৎ বিল, পানি বিল, নেট বিল, ডিস লাইনের বিল পরিশোধের এ জাতীয় উদ্বেগের সাথে পারিবারিক কলহ, সন্তানসন্ততির অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ চিন্তা সবমিলিয়ে দুর্বিষহ করে তুলছে বেঁচে থাকার স্বাদ। নগরবাসীর উপর সরকার নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন সেবার বিল পরিশোধের আপাতত চাপ না থাকলেও বাসা ভাড়া পরিশোধের চাপ রয়েছে যথারীতি। এই চরম দুর্যোগকালেও বাড়ির মালিক ভাড়াটিয়ার কোন প্রকার সমস্যা শুনতে নারাজ!
মহামারি করোনা ভাইরাসের ফলে সৃষ্ট এই সংকটে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে নানা ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে, তবে সেগুলোর সবই নিম্নআয়ের মানুষের জন্য। বিত্তবানদের তরফ থেকেও এ পর্যন্ত যে সাহায্য সহযোগিতা করা হয়েছে এবং ঈদকে সামনে রেখে যাকাতের অর্থ বণ্টনের যে পরিকল্পনা করা হচ্ছে সেখানেও সমাজের মধ্যবিত্তের কোন স্থান নেই। মধ্যবিত্তদের অর্থ- বিত্ত না থাকলেও আত্মসম্মান খুবই স্পর্শকাতর ইস্যু, ফলে চরম দারিদ্র্যতার মাঝেও আত্মসম্মানের ভয়ে সরকারি রিলিফের খাতায় তারা কেউ নাম লেখাতে পারেন না। কেউ যদি চরম অসহায়ত্ব স্বীকার করে বাধ্য হয়ে দুঃস্থদের সাথে ত্রাণের লাইনে দাঁড়ান, আমাদের চারপাশ তা সহজে মেনে নিতে পারে না। বিভিন্ন ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। এই হচ্ছে সমাজে মধ্যবিত্তের বাস্তব চিত্র।
মহামারি করোনা ভাইরাসের প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতির চাকা এক প্রকার ভেঙে পড়ছে। ভয়াবহ সংকটজনক সময় পার করছে বিশ্বের প্রতিটি দেশ। গবেষণা বলছে, চলতি বছর বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ২ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে আসতে পারে। অর্থনীতি বিশ্লেষকদের মতে, বিশ্ব অর্থনীতিতে ক্ষতির পরিমাণ ১৫ হাজার কোটি মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। সুতরাং খুব সহজেই অনুমান করা যায়, বর্তমানের মতো করোনা পরবর্তী সময়ও আমাদের জন্য খুব একটা সুখকর হবে না। টিকে থাকার লড়াই নিঃসন্দেহে চরম প্রতিযোগিতাপূর্ণ হবে। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না অস্তিত্ব লড়াইয়ের এ প্রতিযোগিতা হতে হবে অবশ্যই পারস্পরিক সহযোগিতার মধ্য দিয়ে। আর এর জন্য সবার অনেক বেশি মানবিক হওয়া দরকার। পারস্পরিক সাহায্য ও সহযোগিতার মাধ্যমেই এই সংকট দূর করতে হবে। কিন্তু আমাদের চারপাশে বাস্তবে কী ধরনের ঘটনা ঘটছে?
করোনাকালে রাজধানীর ধানমন্ডির কাঠালবাগান এলাকায় সামান্য এক মাসের ভাড়া দিতে না পারায় ঝড়ের রাতে তিন শিশুসহ এক দম্পতিকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছেন বাড়ির মালিক। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হস্তক্ষেপেও বাড়ির মালিক দমে জাননি! বরগুনায় বাস চালক মোঃ ফারুক এক মাসের বাসা ভাড়া পরিশোধে ব্যর্থ হওয়াই তার ঘর থেকে রান্নার চাল নিয়ে গেছে বাড়ির মালিক! আবার বগুড়ায় ভাড়া দিতে না পারায় সরকারি আজিজুল হক কলেজের পাঁচ ছাত্রীকে আটকে রেখেছেন মেস মালিক। এমন অসংখ্য অমানবিক ও বিব্রতকর ঘটনা চারপাশে ঘটছে ; কিছু ঘটনা সামাজিক ও গণমাধ্যমের কল্যাণে জানা যাচ্ছে, এমন অনেক ঘটনাই থেকে যাচ্ছে সবার অগোচরে।
রাজধানীসহ বিভিন্ন শহরে যেসব ভাড়াটিয়া বসবাস করেন এদের অধিকাংশই মধ্যবিত্ত পরিবার। এদের অধিকাংশই হয়ত চাকরি, নয়তো ছোটখাটো ব্যবসা করেন। আবার শহরে আরেকটা শ্রেণীর মানুষ ভাড়া বাড়িতে বসবাস করেন যারা শহরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ুয়া, নয়তো বেকার। এদের কোন শ্রেণীতে ফেলবো ঠিক বুঝতে পারছি না। উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত এসব যুবক- যুবতীর অনেকেই পার্ট- টাইম জব করে অথবা টিউশনি করে নিজের খরচ জোগানোর পাশাপাশি পরিবারকেও সহায়তা করেন। কিন্তু করোনাকালে তাদেরও সকল জীবিকার পথ বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে আর্থিক সংকটের কারণে অনেকেই বাসা বা মেস ছেড়ে গ্রামে ফিরে যাচ্ছেন। অনেকে নিরুপায় হয়ে হয়ত মেসের মাসিক বিল কিংবা বাসা ভাড়া দিতে অপারগ হচ্ছেন। কিন্তু তাই বলে তাদের বাসা থেকে অপমান করে বের করে দিতে হবে? এ কোন ধরনের অমানবিক আচরণ, এটা কোন ধরনের অসভ্যতা? এই মহামারির সময়েও যদি মানুষের মনুষ্যত্ব না জাগে তাহলে আর কবে জাগবে? অমানুষ থেকে মানুষ হয়ে উঠার এখনই তো উত্তম সুযোগ।
রাজধানীসহ অন্যান্য শহরগুলোতেও বাড়ির মালিকদের আচরণ অনেকাংশে কর্তৃত্ববাদী। বাসা ভাড়া দেয়ার পরও ভাড়াটিয়াদের জন্য বাড়ির মালিকদের হাজারটা অলিখিত নিয়ম। এছাড়া বছর শেষে কারণে- অকারণে বাসা ভাড়া বৃদ্ধির নির্ধারিত যন্ত্রণা তো আছেই। আর ব্যাচেলর হলে তো মরার উপর খড়ার ঘা। তবুও মানুষ একটু মাথা গুঁজার জন্য নিরুপায় হয়ে বাড়ির মালিকদের সকল অন্যায় আবদার নিরবে সহ্য করে। দেশে বাসা ভাড়া সংক্রান্ত আইন থাকলেও বাড়ির মালিক তা থোরায় কেয়ার করেন। ভাড়াটিয়াও আইনের আশ্রয়প্রার্থী হওয়া এক প্রকার ঝামেলা মনে করে বাসার মালিকের বিরুদ্ধতা না করে সব কিছু মেনে নিয়ে বসবাস করেন। কিন্তু বাড়ির মালিকদের এই নিরব অত্যাচার আর কতদিন চলবে? তবে এত অভিযোগের মাঝেও কিছু বাসার মালিক আছেন যারা খুব মানবিক এবং ভাড়াটিয়ার বিপদে পাশে দাঁড়ান।
অস্বীকার করবো না অনেক বাড়ির মালিকের পরিবার শুধু বাড়ি ভাড়ার ওপরেই নির্ভরশীল। তাদের অনেকেই ঋণ নিয়ে বাড়ি নির্মাণ করেছেন। ভাড়ার টাকা দিয়ে নিয়মিত ব্যাংকের কিস্তি পরিশোধ করেন। এমতাবস্থায় ঋণগ্রস্ত বাড়ির মালিকদের উপরও একটা অর্থনৈতিক চাপ আছে। কিন্তু তাই বলে কি তারা অমানবিক আচরণ করবে? আর অমানবিক আচরণ করলেই কি সমস্যার সমাধান হবে?
করোনাকালীন অধিকাংশের সার্বিক দুরবস্থা বিবেচনা করে এ জাতীয় সমস্যা সমাধানে সরকারকে দ্রুত বাস্তবসম্মত ও যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে এ জাতীয় সমস্যা বাড়তেই থাকবে। বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়া উভয়পক্ষের সুবিধার কথা চিন্তা করে সরকার এই সংকটকালে বাসা ভাড়া যৌক্তিক পর্যায়ে পুনর্নির্ধারণ করতে পারে। এক্ষেত্রে বাড়ির মালিকদের বাসা ভাড়ার বিষয়ে খুব বেশি মানবিক হওয়া দরকার। আর সরকার এই দুর্যোগকালীন নির্দিষ্ট একটা সময় পর্যন্ত বাড়ির মালিকদের হোল্ডিং ট্যাক্স মওকুফ করে দিতে পারে। এছাড়া যেসব মালিকদের ব্যাংক ঋণ আছে তাদের ব্যাংক ঋণের কিস্তি নির্দিষ্ট একটা সময় পর্যন্ত সুদ মুক্ত অবস্থায় স্থগিত করতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে আদেশ দিতে পারে। এছাড়া বাসা বাড়িতে সরকারি বিভিন্ন সেবার কয়েকমাসের বিল সরকার মওকূপ করতে পারে। এতে মানুষের ওপর অনেকাংশে অর্থনৈতিক চাপ কমবে। সমস্যা সমাধানে আন্তরিকার সাথে সবাইকে এগিয়ে আসার এখনই সময়।
"সকলের তরে সকলে আমরা/ প্রত্যেকে মোরা পরের তরে ”।
--- দুর্যোগকালীন এই সময়ে মানবিক বোধ সবার মধ্যে জেগে উঠুক।