বহির্বিশ্বে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ হিসেবে আমাদের একটা প্রশংসা
আছে। হাজার বছর ধরে এ অঞ্চলের মানুষেরা মিলেমিশে বসবাস করে আসছে। ধর্মীয়
পরিচয়ের ঊর্ধ্বে ওঠে বিপদে আপদে একে অন্যের পাশে দাঁড়ানোর বহু নজির আছে।
কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ও নৈতিক স্খলনের ফলে
সামাজিক সম্প্রীতির এ বন্ধন যেন দিন দিন হারিয়ে যেতে চলছে। মানুষের মধ্যে
এখন অস্থিরতা বিরাজ করছে, অতি অল্পতেই একজন অন্যজনকে শারীরিক বা মানসিকভাবে
আঘাত করছে। দুঃখজনক, আধুনিক এই যুগে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষা দীক্ষা
প্রসারের ফলে মানুষের মাঝে নীতি-নৈতিকতা, সামাজিক মূল্যবোধ বৃদ্ধি পাওয়ার
কথা থাকলেও উদ্বেগজনকভাবে কমে যাচ্ছে! মূল্যবোধ অবক্ষয়ের নেতিবাচক প্রভাব
পড়ছে সমাজ ও রাষ্ট্রে।
সম্প্রতি রংপুরের সদর উপজেলার পাগলাপীর
ঠাকুরবাড়ি গ্রামে ফেসবুকে এক হিন্দু ছেলের কথিত একটি স্ট্যাটাসে ইসলাম
ধর্মের অবমাননার অভিযোগে সেখানে ব্যাপক তাণ্ডব চালিয়েছে একদল ধর্মীয়
উগ্রবাদী। তারা হিন্দুদের বাড়িতে আগুন দিয়ে ইচ্ছামতো লুটপাট করেছে।
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানতে পারলাম, উগ্রবাদীদের দেয়া আগুনে গ্রামের
প্রায় ৩০টি হিন্দু বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেখানে বসবাসরত শত শত হিন্দু
পরিবার এখন আছে নিরাপত্তাহীনতায়। আবারও হামলার আশঙ্কায় চরম আতঙ্কের মধ্যে
আছেন তারা। ধর্ম রক্ষার নামে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার এ এক নগ্ন খেলা।
সংখ্যালঘুদের ওপরে হামলা, নির্যাতন, তাদের উপাসনালয়-প্রতিমা ভাঙচুর,
ঘরবাড়ি-দোকানপাটে হামলা ও লুটপাটের ঘটনা নতুন না। তাদের জায়গা-জমি দখল করা
কিংবা স্বল্পমূল্যে বিক্রি করতে বাধ্য করার মতো অভিযোগও অনেক পাওয়া যায়।
প্রতিনিয়ত দেখে আসছি যে, কারণে অকারণে সহিংস নির্যাতনের শিকার হন আমাদের
দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষরা। ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর
কক্সবাজারের রামুতে এক বৌদ্ধপল্লীতে একই অভিযোগ তুলে সেখানে ব্যাপক সংহিসতা
চালিয়েছিল উগ্রবাদীরা। উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠী রামুর ১২টি প্রাচীন বৌদ্ধ
বিহার ও ৩২টি বসতঘরে অগ্নিসংযোগ করেছিল। এ সময় আরও ছয়টি বৌদ্ধ বিহার ও
শতাধিক বসতঘরে ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছিল। পরদিন উখিয়া-টেকনাফে আরও
কয়েকটি বৌদ্ধ বিহার ও বসতিতে একই ঘটনা ঘটেছিল। রামুর ক্ষত না শুকাতেই গত
বছর (২০১৬ সালের ২৮ অক্টোবর) একই অভিযোগে আবার ব্রাক্ষণবাড়িয়ার নাসিরনগর
উপজেলার হিন্দু সম্প্রদায়ের শতাধিক পরিবার এবং তাদের মন্দিরের ওপর হামলা
চালায় মৌলবাদী গোষ্ঠী। কিন্তু কেন এমন ধারাবাহিক হামলা? রাষ্ট্র অবশ্যই এ
প্রশ্নের দায় এড়াতে পারে না। ফেসবুকে আপত্তিকর স্ট্যাটাস দিয়ে যদি কেউ
অপরাধ করে দেশের প্রচলিত আইনে তার সাজা হোক। তাই বলে একজনের অপরাধে তার
সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের ঘরবাড়িতে হামলা করে আগুন ধরিয়ে মালামাল লুট করতে
হবে, এটা কেমন অবিচার?
একের পর এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় মনে প্রশ্নে
জাগে, সংখ্যালঘুরা কি রাষ্ট্রের নাগরিক নয়? স্বাধীনভাবে কি এরা এদেশে বসবাস
করতে পারবে না? এদের নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব কি রাষ্ট্রের ওপর বর্তায় না?
হলফ করে বলতে পারি রামু, উখিয়া, নাসিরনগরের ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে যারা
প্রকৃত দোষী ছিল তাদের যদি যথাযথ বিচারের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির
ব্যবস্থা করা হতো তবে এসব নোংরা ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটত না। কিন্তু ভোটের
রাজনীতিতে কেউ-ই দায় নিয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বার্থ রক্ষায় তৎপর হওয়ার
আগ্রহ পায় না। আর এই দায়হীনতার সংস্কৃতি থেকে বিচারহীনতার সংস্কৃতি গড়ে
উঠেছে। রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রভাবিত বিচার ব্যবস্থায় কোনো ঘটনাকে যদি রাজনৈতিক
রূপ দেয়া যায় তাহলে তা যতই ক্ষমার অযোগ্য হোক না কেন, সুবিচার পাওয়া খুব
কঠিন হয়ে পড়ে।
‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’ বাংলা ভাষায় প্রচলিত একটা জনপ্রিয়
প্রবাদ। আমাদের দেশের ধর্মান্ধদের দৃষ্টিতে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় যেন
নন্দ ঘোষ! গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচন একপ্রকার উৎসব। ভোটাধিকার প্রতিটি
নাগরিকের রাজনৈতিক অধিকার। কিন্তু দেখা যায়, জাতীয় নির্বাচন মানেই হিন্দু
সম্প্রদায়ের জন্য আতঙ্ক। নির্বাচনে ব্যাপক সহিংসতার শিকার হন সংখ্যালঘু
সম্প্রদায়ের মানুষগুলো। অধিকাংশ সময় স্বাধীনভাবে তারা ভোটাধিকার পর্যন্ত
প্রয়োগ করতে পারেন না। কোথাও তারা কোনো প্রার্থীকে ভোট দেয়ার অভিযোগে
নির্যাতনের শিকার হন, কোথাও তাদের ওপর আক্রমণ আসে কোন প্রার্থীকে ভোট না
দেয়ার অভিযোগে। এ যেন জলে কুমির ডাঙায় বাঘ অবস্থা। আওয়ামী লীগ সরকার গঠন
করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করে। আদালতের বিচারে যুদ্ধাপরাধীদের
কয়েকজনের ফাঁসি কার্যকর হয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করেও এক শ্রেণীর মৌলবাদী
গোষ্ঠী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা চালায়। অথচ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের
সাথে কিন্তু সংখ্যালঘুদের কোন সম্পৃক্ততা নেই। বিভিন্ন সময় দেশের ভিতরে
কিংবা দেশের বাইরের বিভিন্ন ইস্যুকে (বাবরি মসজিদে হামলা) কেন্দ্র করে
ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নির্যাতনের শিকার হতে হয়। এটা বহু রক্তের
বিনিময়ে পাওয়া মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের চেতনার বিচ্যুতির প্রমাণ।
মহান
মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনাই ছিল অসাম্প্রদায়িক ও শোষণমুক্ত একটা রাষ্ট্র
গড়ার। কিন্তু স্বাধীনতার এত বছর পরও জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের সেই স্বপ্নের
বাংলাদেশ আজও প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। ফলে দেশে সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের
ঘটনা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিরাপত্তার অভাব বোধ থেকে অনেক সংখ্যালঘু
পরিবার নীরবে দেশ ত্যাগ করেছেন। কেউ স্বীকার করুক আর না করুক নাগরিক হিসেবে
পূর্ণ অধিকার নিয়ে থাকতে না পারা এবং জানমালের পূর্ণ নিরাপত্তা না পাওয়ার
কারণেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায় দেশ ত্যাগ করছেন। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে,
স্বাধীনতার চার দশকের মধ্যে দেশে জনসংখ্যা দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেলেও মূলত
ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সংখ্যা কমেছে। অনেকে বলেন, সংখ্যালঘুদের জন্মহার কম
হওয়ার দিন দিন সংখ্যা কমে যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলে। জাতির
জনক শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই সংখ্যালঘুরা দ্রুত দেশত্যাগ
শুরু করেন। সেই ধারা এখনো অব্যাহত আছে। প্রাপ্ত তথ্য মতে, স্বাধীনতার সময়
এদেশে সংখ্যালঘুদের হার ছিল ২০-২১ ভাগ। কিন্তু বর্তমানে এই হার কমে এখন ৯.৭
শতাংশ।
জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে একটা অপশক্তি দেশকে অস্থিতিশীল
করার পাঁয়তারা শুরু করেছে। এরা আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সম্পর্ককে
বিনষ্ট করে আস্থার সংকট সৃষ্টি করতে চায়। উগ্রসাম্প্রদায়িক ও জঙ্গিবাদী
গোষ্ঠী নির্যাতন ও অত্যাচারের মাধ্যমে সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগে বাধ্য করার
জন্য তৎপর হয়ে উঠেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বাস্তবায়িত করার জন্য যে কোন
মূল্যে এই অপশক্তির বিরুদ্ধে আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে। রাজনৈতিক পরিচয়ের
ঊর্ধ্বে ওঠে যারা এসব অপকর্মের সঙ্গে জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি
নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি আমাদের ভুলে গেলে চলবে না ধর্মনিরপেক্ষ একটি
দেশ হিসেবে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ হিসেবে
আমাদের যে হাজার বছরের ঐতিহ্য আছে সেই সম্প্রীতির বন্ধন অটুট রাখতে দেশের
সংখ্যালঘু নির্যাতন বন্ধের কোনো বিকল্প নেই।
No comments:
Post a Comment