কম্বলের উষ্ণ পরশ উপেক্ষা করে কুয়াশায় ঘেরা কাকডাকা ভোরে তীব্র শীতের মধ্যে
ঘুম থেকে উঠে যায় মেহেদী। প্রায় দুই মাইল রাস্তা সাইকেল চালিয়ে প্রতিদিনই
সময়মতো চৌরাস্তার মোড়ে হাজির হয় তার ভালোবাসার মানুষটিকে একনজর দেখার আশায়।
যেদিন সময়মতো আসতে ব্যর্থ হয়, সেদিন আর তার প্রিয়তমার সঙ্গে দেখা হয় না।
বীথির মুখখানি না দেখলে মেহেদীর সারাটা দিন মলিন হয়ে যায়। কোনো কাজে তার মন
বসে না। সব কিছুই কেমন জানি এলোমেলো হয়ে যায়। বীথি অবশ্য মেহেদীর এ
অনুভূতির বিষয়ে কিছুই জানে না। চৌরাস্তার মোড়ে মেহেদীকে প্রায় প্রতিদিনই সকালে
দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিছুটা ধারণা করেছে, ছেলেটা হয়তো তাকে পছন্দ করে।
কিন্তু সরাসরি যেহেতু এ বিষয়ে মেহেদী তাকে কিছু বলেনি, সুতরাং আগ বাড়িয়ে
এমন চিন্তা করা অনর্থক বলে মনে করে সে। এ ছাড়া গ্রামের প্রতিবেশীরা যদি
বিষয়টা জানতে পারে, তাহলে তিলকে তাল বানিয়ে ছাড়বে। চুপচাপ থাকাই ভালো। দেখা
যাক কী হয়-মনে মনে এসব ভেবে বীথিও মেহেদীকে কিছু জিজ্ঞেস করে না। তবে
মেহেদীর জন্য যে তার মনের মধ্যে নিজের অজান্তেই একটা জায়গা তৈরি হয়েছে, এটা
সে ভালোভাবেই বুঝতে পারে। এ ছাড়া মেহেদীকে নিয়ে কেনই বা সে ভাবতে যাবে!
প্রতিদিনের মতো আজও কাকডাকা ভোরে মেহেদী রাস্তার মোড়ে বীথির অপেক্ষায়
দাঁড়িয়ে আছে। সাইকেলটা রাস্তার পাশে গাছের সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড় করানো।
সাইকেলের পেছনে এক-দুইটা বই-খাতা। খাতার ভাঁজে দুটি লাল গোলাপ জড়ানো।
প্রাইভেট পড়ার উদ্দেশ্যে সে মূলত বাড়ি থেকে প্রতিদিন বের হয়। কিন্তু বীথির
অপেক্ষায় থাকতে থাকতে অধিকাংশ দিনই তাঁর প্রাইভেট পড়া হয় না। মেহেদী আজ
বীথিকে তার ভালোবাসার কথা বলবে বলে ঠিক করেছে। ভোরবেলা বাসা থেকে বের হওয়ার
সময় প্রতিদিনই সে এ কথা ভাবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর বলা হয় না। এ
ব্যর্থতার কারণে প্রায়ই বন্ধুদের কাছে তাকে গালাগাল শুনতে হয়। এরই মধ্যে
বন্ধুরা তাকে ‘ভীতুর ডিম’ নামে ডাকা শুরু করেছে। মেহেদীর জন্য ব্যাপারটা
ইনসাল্টিং। সে আর এ ধরনের অপমান সহ্য করতে রাজি না। তাই আজ সে সিদ্ধান্ত
নিয়েছে, যে করেই হোক বীথিকে সব কথা খুলে বলবেই। প্রথমে ভেবেছিল, একটা চিঠির
মাধ্যমে বীথিকে সব কথা জানাবে। কিন্তু পরে চিন্তা করে দেখল, ভীরুর মতো
চিঠি দেওয়া ঠিক হবে না। এ ছাড়া ডিজিটাল যুগে চিঠিপত্র খুব বেমানান। তাই
সিদ্ধান্ত নিয়েছে সাহসী পুরুষের মতো বীথির হাতে লাল গোলাপ ধরিয়ে দিয়ে
অব্যক্ত অনুভূতি সরাসরি ব্যক্ত করবে। চৌরাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসব
কথাই ভাবছে মেহেদী। হঠাৎ দূরে তাকিয়ে দেখল, বীথি আসছে। প্রচণ্ড শীতের
প্রকোপ থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য তার গায়ে হালকা গোলাপি রঙের চাদর মোড়ানো।
ওড়না দিয়ে মুখের প্রায় অর্ধেকটা ঢাকা। শীতের কুয়াশা আবৃত সকালে অন্য মানুষ
চিনতে কষ্ট হলেও বীথিকে চিনতে মেহেদীর কোনো কষ্ট হয় না। বীথির আগমনী
বার্তায় মুহূর্তের মধ্যে মেহেদীর হৃদয়ে স্পদন বেড়ে গেল। এত সময়ের ভাবনা
মুহূর্তের মধ্যে এলোমেলো হয়ে গেল। কী করা উচিত আর কী করা অনুচিত-এ ভেবেই সে
বিচলিত হয়ে উঠল। প্রতিদিনের মতো আজও বীথি তার সামনে দিয়ে চলে গেল; কিন্তু
সে কিছুই বলতে পারল না। লাল গোলাপ দুটি খাতার ভাঁজেই পড়ে থাকল। এভাবেই
অসংখ্য তাজা গোলাপ মেহেদীর খাতার ভাঁজে শুকিয়ে শুকিয়ে নষ্ট হয়েছে। একটি
একটি করে ঝরে পড়েছে লাল পাপড়ি। অনেক দিন পর অপ্রত্যাশিতভাবে একটা হোটেলের
সামনে মেহেদীর সঙ্গে বীথির দেখা হয়। সেদিনও বীথিকে ডেকে কথা বলার সাহস হয়নি
মেহেদীর। তবে আগের মতো বীথি এদিন আর মেহেদীর সঙ্গে কথা না বলে যায়নি। আপনি
মেহেদী ভাই না? বীথির এ প্রশ্নে মুহূর্তের মধ্যেই মেহেদীর কাকডাকা ভোরের
হারানো স্মৃতি হৃদয়ের মানসপটে ভেসে ওঠে। বীথির চিরচেনা মুখখানি যেন অচেনা
মনে হয় তার কাছে। আনমনা হয়ে সে বীথির মুখপানে চেয়ে থাকে অপলক দৃষ্টিতে।
কেমন আছেন আপনি? ‘শীতের সকালে বইয়ের ভাঁজে লুকিয়ে রাখা ঠিক সেই লাল গোলাপের
মতো। প্রিয়তমার হাতের স্পর্শ পাওয়ার সৌভাগ্য কারোই যে হয়নি’-বীথির
প্রশ্নের প্রত্যুত্তরে কৃত্রিম হাসি দিয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে কথাগুলো বলে
দ্রুত স্থান ত্যাগ করে মেহেদী।
No comments:
Post a Comment