আজ (১২ জানুয়ারি) জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা দিবস। নগরজীবনের কোলাহলমুক্ত শান্ত নিবিড় পরিবেশে প্রকৃতির এক নান্দনিক সৌন্দর্যের মাঝে আজ থেকে ৪৭ বছর আগে এদিনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দেশের উচ্চশিক্ষার অন্যতম বিদ্যাপীঠ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। দেশের একমাত্র এ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়টি সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ক্ষেত্রে একক বৈশিষ্ট্যের দাবিদার। নিসর্গের সঙ্গে মিশে আছে আধুনিক স্থাপনাশৈলী। শিক্ষা-গবেষণার ক্ষেত্রেও বিশ্ববিদ্যালয়টি অনন্য। প্রতিষ্ঠার পর থেকে দেশের অগ্রযাত্রার অগ্রপথিক হিসেবে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স স্বাধীন বাংলাদেশের সমান। ১৯৭১ সালের ১২ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ও বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর রিয়ার অ্যাডমিরাল এসএম আহসান আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় উদ্বোধন করেন। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের সময় ১৯৭০ সালের ২০ আগস্ট তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার এক অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে নতুন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম রাখে ‘জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়।’ স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে ১৯৭৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট পাস করা হয়। এ অ্যাক্টে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম রাখা হয় ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়’। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে ৪টি বিভাগ ও ১৫০ ছাত্রছাত্রী নিয়ে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল। ইতিহাসের এ পথপরিক্রমায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় আজ দেশের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমানে ৬টি অনুষদের অধীনে ৩৫টি বিভাগ ও ৪টি ইনস্টিটিউটে প্রায় ১৬ হাজার ছাত্রছাত্রী লেখাপড়া করছে। বর্তমানে শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় ৬৬৪ জন।
শিক্ষা ও গবেষণার পাশাপাশি এদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক নানা আন্দোলনে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। এরশাদ সরকারের আমলে শিক্ষা আন্দোলন ও ১৯৯০ সালের স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলনে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করেছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের সবুজ ক্যাম্পাস চত্বরে কোন অন্যায় মুখ বুজে সহ্য করেনি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের সাহসী স্লোগানে বারবার প্রকম্পিত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ। যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে যে আন্দোলনের সূচনা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত হয়েছিল তা এখন সারাদেশেই বিস্তৃত। এধরনের নিপীড়নের ঘটনা শুধু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েই ঘটে না, সারা দেশেই বিচ্ছিন্নভাবে সংঘটিত হয়। তবে সাহসিকতার সঙ্গে প্রথম প্রকাশ্যে এর প্রতিবাদ হয়েছিল এ বিশ্ববিদ্যালয়েই। এই আন্দোলন দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম যৌন নিপীড়নবিরোধী আন্দোলন বলে আজও পরিচিত।
প্রতিষ্ঠার এ ৪৭ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রযাত্রায় গৌরবোজ্জ্বল অনেক কীর্তি সাধিত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টি এ অল্প সময়ে দেশকে অনেক কিছু দিয়েছে। দিয়েছে দেশ-বিদেশে অনেক খ্যাতি ও গৌরব। প্রতিষ্ঠিত করেছে দেশ-বিদেশে আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান প-িত ও গবেষক। আজ দেশের নানা গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে রয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীরা। আন্তর্জাতিকভাবেও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক কৃতী শিক্ষার্থী। এটি জাবিয়ানদের জন্য বেশ আনন্দের ও ম্লাঘার বিষয়।
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বিশ্ববিদ্যালয়টির ভূমিকা ও সম্ভাবনার পাশাপাশি কিছু প্রত্যাশা ও সমস্যার কথা না বললেই নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করা ও শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক ন্যায্য অধিকার আদায়ের প্রাণকেন্দ্র বলা হয় বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র-সংসদকে। কিন্তু জাকসু প্রায় দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে অকার্যকর রয়েছে। বর্তমান ভিসি অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম দায়িত্ব গ্রহণের পর জাকসু কার্যকর করার ঘোষণা দিয়েছিলেন; কিন্তু দায়িত্ব গ্রহণের পর কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। জাকসু নির্বাচন দাবিতে বিভিন্ন সময় শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন, আলোচনা সভা, স্মারকলিপিসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করলেও তা মূলত আশ্বাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গত মাসে দীর্ঘ ১৯ বছর পর রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিজয়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ প্যানেলের পক্ষ থেকে জাকসু নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। এখন প্রতিশ্রুতি পূরণের অপেক্ষা।
দেশের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ আবাসিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তকমা থাকলেও বাস্তবে তীব্র আবাসিক সংকট রয়েছে। এছাড়া আবাসিক হলগুলোর ডাইনিং ও ক্যান্টিনে নিম্নমানের খাবার খেয়ে শিক্ষার্থীদের জীবনধারণ করতে হয়, যা মেধা বিকাশের পথে অন্তরায়। ক্যাম্পাসে বটতলায় যে হোটেলগুলো আছে সেগুলো খুব বেশি বাণিজ্যিক। ফলে শিক্ষার্থীদের হোটেলগুলোতে চড়া মূল্যে অস্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্রের নাজুক অবস্থা। প্রশাসনের অযতœ ও অবহেলায় সুইমিংপুলটি দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। বহিরাগতদের অনিয়ন্ত্রিত ও বিশৃঙ্খল চলাফেরায় ক্যাম্পাসের প্রাকৃতিক ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে। শিক্ষক নিয়োগদানে স্বজনপ্রীতি, ক্লাসরুম সংকট, লাইব্রেরিতে তীব্র আসন সংকট, পরিবহন সংকট, গবেষণার জন্য অপর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ, ধীরগতির ওয়াইফাই কানেকশনসহ নানা সমস্যা বিদ্যমান। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের একটু আন্তরিকতাই বিদ্যমান এসব সমস্যা দূর করার জন্য যথেষ্ট। সব সমস্যা দূর হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির অগ্রগতির ধারা অব্যাহত থাকুক। আদর্শিক মূল্যবোধ, অন্তর্মুখী ধ্যান ও প্রকৃত মনুষ্যত্ব বিকাশে আগামী দিনে জাবি নেতৃত্ব দেবে- এমনটাই প্রত্যাশা। প্রাণের বিদ্যাপীঠ হয়ে উঠুক উচ্চশিক্ষার প্রাণকেন্দ্র। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখরিত হোক প্রিয় ক্যাম্পাস। শুভ জন্মদিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।