Friday, 30 December 2016

অপরিকল্পিত পর্যটনে বিশ্ববিদ্যালয় যখন বিনোদন পার্ক


কয়েক সপ্তাহ ধরে এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের। এ বিপত্তি নিয়ে অনেক দৈনিক পত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মাধ্যমে যেমন ফলাও করে সংবাদ প্রচার হচ্ছে, তেমনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও সমান সোচ্চার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নীরব শান্তিপূর্ণ প্রতিবেশে নাগরিক কোলাহল কাঙ্ক্ষিত ছিল না। কিন্তু সম্প্রতি ঢাকার ব্যস্ত রাস্তার মতো ভয়াবহ যানজট জাহাঙ্গীরনগরের রাস্তায়। বলতে গেলে কিছু মুখস্থ উপমা যেমন— নগরজীবনের কোলাহলমুক্ত শান্ত নিবিড় পরিবেশে লাল ইটে মোড়ানো প্রকৃতির এক নান্দনিক সৌন্দর্যের মাঝে অবস্থিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, দেশের একমাত্র এই আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়টি সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ক্ষেত্রে একক বৈশিষ্ট্যের দাবিদার, ক্যাম্পাসের মুক্ত মঞ্চে সারা বছর বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নিয়ম করে প্রতি বছর শীত মৌসুমে অতিথি পাখির আগমন, লাল পদ্ম ফোটা লেকের জলে ডাহুকের ডুবসাঁতার, প্রত্যুষে কিংবা গোধূলি লগ্নে হরেক প্রজাতির পাখির কিচিরমিচির শব্দ, শীতের রাতে শিয়ালের হাঁকডাক, পিচঢালা রাস্তায় বীরের বেশে গুইসাপের স্বাধীনচেতা ঘোরাফেরা, ফুলে ফুলে প্রজাপতির ডানা মেলে ওড়াউড়ি, গাছের ডালে লক্ষ্মীপেঁচার অভিমানী শান্ত মুখ এ ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে বহুগুণ— এগুলোই করেছে সর্বনাশ। সবাই সৌন্দর্য আর সবুজের গল্প শুনে আগ্রহী হয়েছে। প্রত্যেকেই চাইছে নাগরিক কোলাহলমুক্ত হয়ে একটু শান্তির পরশ নিতে। আর তাতেই হুমকির মুখে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবেশ, ব্যাহত হচ্ছে এখানকার শিক্ষা কার্যক্রম। সবাই স্পষ্ট করে বলতে শুরু করেছেন, একটা আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় আর যা-ই হোক, বিনোদন পার্ক হতে পারে না।
প্রকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্ত-নির্জন পরিবেশ এখন অতিথি পাখির কিচিরমিচির শব্দে মুখর। পুরো ক্যাম্পাস যেন পরিযায়ী পাখির দখলে। হেমন্তের কুয়াশা আবৃত সকালে অতিথি পাখির কলকাকলিতে ঘুম ভাঙে ক্যাম্পাসবাসীর। ক্যাম্পাসের জলাশয়ে ১৯৮৮ সালের দিকে প্রথমবারের মতো অতিথি পাখি আসে। এর পর থেকে ক্যাম্পাসে প্রতি বছর নানা প্রজাতির অতিথি পাখি নিয়মিত আসে। এদের বেশির ভাগই হাঁসজাতীয় ও ক্যাম্পাসের লেকের পানিতে বসবাস করে। এর মধ্যে হাঁসজাতীয় সরালি, পাতারি হাঁস, পাতিতারা, গয়ার, বামুনিয়া হাঁস, বাড়িঘোরা, পান্তামুখী, ছোট জিরিয়া, চিতাটুপি, জলপিপি, পানকৌড়ি ইত্যাদি প্রধান। ২০০১ সালে প্রথমবার পরিবেশ ও প্রকৃতিকে বাঁচাতে জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য পাখিমেলা আয়োজন করা হয়। এর পর থেকে প্রতি বছর এ মেলার আয়োজন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ। প্রতি বছর সুদূর সাইবেরিয়া থেকে ক্যাম্পাসে আগত পরিযায়ী পাখি এবং প্রজাপতি সংরক্ষণে গণসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রাণিবিদ্যা বিভাগ কর্তৃক আয়োজিত ব্যতিক্রমী প্রজাপতি মেলা এখানকার পরিচিতিকে বিকশিত করেছে দেশব্যাপী, বয়ে এনেছে এক স্বতন্ত্র মর্যাদা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অনন্য নয়নাভিরাম সৌন্দর্য বর্তমানে ক্যাম্পাসবাসীর জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রকৃতির মাঝে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ার আশায় ক্যাম্পাসে ছুটির দিনে দর্শনার্থীদের ঢল নামে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার, বটলতা, ট্রান্সপোর্ট চত্বর, টারজান পয়েন্ট, ক্যাফেটেরিয়া, প্রজাপতি গবেষণা কেন্দ্র, সুইমিং পুল, বোটানিক্যাল গার্ডেনসহ প্রতিটি জায়গায় দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড়। গ্রীষ্ম ঋতুর তুলনায় শীতের সময়ে দর্শনার্থীর আগমন বেড়ে যায়। ক্যাম্পাসে শীতের পিঠা খেতে খেতে সুদূর সাইবেরিয়া থেকে আগত পাখিদের খুনসুটি, স্বচ্ছ জলে ফোটে থাকা লাল শাপলার সৌন্দর্য, হরেক প্রজাতির সবুজের মাঝে নগর জীবনে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে কার না ভালো লাগে! বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থানরত শিক্ষার্থীদের আতিথেয়তা ও উদার মনোভাব এবং নিরাপত্তা দর্শনার্থীদের জন্য এমন অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। বাঙালির এই আতিথ্য মনোভাব বংশজাত। আমাদের রক্তে মিশে আছে। হিন্দু ধর্মীয় শাস্ত্রে অতিথিকে দেবতা ‘নারায়ণ’-এর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। বাঙালির কাছে অতিথির মর্যাদা ও সম্মানের গুরুত্ব ঢের।
কিন্তু জাহাঙ্গীরনগরে দর্শনার্থীদের অবাধ বিচরণ ইদানীং রীতিমতো অত্যাচারে রূপ নিয়েছে। বিরক্ত হয়ে বর্তমানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অনেকেই ক্যাম্পাসে দর্শনার্থীদের বিশৃঙ্খল বিচরণে আপত্তি করছেন। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আপত্তির প্রধান কারণ, দর্শনার্থীদের অধিকাংশ ভুলে যান যে, এটা দেশের স্বনামধন্য একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। ক্যাম্পাসে আসা দর্শনার্থীদের চালচলন ও আচার-আচরণে মনে হয়, জাহাঙ্গীরনগর যেন পর্যটনকেন্দ্র! ক্যাম্পাসের যেখানে সেখানে গাড়ি পার্কিং, সংরক্ষিত অঞ্চলে অবাধ বিচরণ, উচ্চ শব্দে গাড়ির হর্ন বাজানো, যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা ফেলা, ছবি তোলার জন্য লেকের পানিতে ঢিল ছুড়ে পাখিদের উড়তে বাধ্য করা— এমন কর্মকাণ্ডে অবস্থানরত শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি ক্যাম্পাসের অবস্থা নাজেহাল। ক্যাম্পাসের সৌন্দর্যও দিন দিন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
এ অবস্থা চলতে থাকলে অতিথি পাখিরা ক্যাম্পাসকে অনিরাপদ মনে করবে এবং ভবিষ্যতে তাদের আর পদ্ম ফোটা লেকে দেখা যাবে না। প্রকৃতিক সৌন্দর্যও একপর্যায়ে বিনষ্ট হবে। ক্যাম্পাসে অহিংস্র প্রাণীর উপস্থিতি দিন দিন হ্রাস পাবে। প্রকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি নামে ক্যাম্পাসের যে খ্যাতি আছে, তা একদিন চিরতরে হারাবে। বর্তমানে শিক্ষার্থীদের জন্য সবচেয়ে বড় হয়ে উঠেছে খাবারের সমস্যা। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের উদাসীনতার কারণে হলগুলোর ডাইনিং ও ক্যান্টিনে নিম্নমানের খাবার। ফলে শিক্ষার্থীদের বৃহৎ অংশ বটতলার হোটেলের খাবারের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু ছুটির দিনে দর্শনার্থীদের বাড়তি চাপে হোটেলগুলোর খাবার দ্রুত শেষ হয়ে যায়। দোকানদাররা শিক্ষার্থীদের কাছে বাড়তি দাম দাবি করেন।
অধিক লাভের আশায় হোটেলের মালিকদের কাছে শিক্ষার্থীদের তুলনায় দর্শনার্থীরা বেশি গুরুত্ব পায়। খাবার না পেয়ে অনেক শিক্ষার্থীকে অনাহারে থাকতে হয়। এছাড়া উপচে পড়া মানুষের ভিড়ে, গাড়ির হর্ন, কোলাহল ও ধুলাবালি মিলে এমন বিশ্রী পরিবেশ সৃষ্টি হয় যেন মনে হয়, এটা কোনো আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় নয়, বাণিজ্যিক মেলা! এসব বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা প্রাণের ক্যাম্পাসের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাদের খুব বেশি উদ্বিগ্ন করে। এরই মধ্যে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষকদের মধ্যেও অনেকে ক্যাম্পাসের পরিবেশ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। জনৈক এক শিক্ষক তার ফেসবুকে লিখেছেন, ওয়েলকাম টু জাহাঙ্গীরনগর পার্ক! ক্যাম্পাসে দর্শনার্থী ঘুরতে আসবে এটা খুব স্বাভাবিক। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের এ বিষয়ে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু দর্শনার্থীদের মনে রাখতে হবে এটা আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়, কোনো পর্যটনকেন্দ্র নয়। তাদের ভদ্রতা বজায় রেখে সুন্দর ও শৃঙ্খলভাবে সৌন্দর্য উপভোগ করা উচিত।
আবাসিক এলাকায় জনসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকে। প্রবেশের অনুমতি থাকলেও নানা বিধিনিষেধ মেনে চলতে হয়। সেখানে একটা আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কীভাবে মানুষ এভাবে অবাধে প্রবেশ করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, তা আমার বোধগম্য নয়। এটি শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়, একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে শিক্ষকরা পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করেন। শিক্ষার্থীদের বৃহৎ অংশ আবাসিক হলগুলোয় অবস্থান করেন। সুতরাং এখানে শিক্ষা ও গবেষণার পরিবেশ বজায় রাখার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে নিরাপত্তাও নিশ্চিত করতে হবে। কিছুদিন আগের ঘটনা। রিকশা করে হলে যাওয়ার পথে সমাজবিজ্ঞান অনুষদের সামনে এক দর্শনার্থীর গাড়ির ধাক্কায় একজন মেয়ে মাটিতে ছিটকে পড়ে আহত হলো। ভাগ্যিস মারাত্মক কোনো বিপদ হয়নি। ক্যাম্পাসে এখন প্রায়ই এমন ছোটখাটো ঘটনা ঘটছে।
বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো দ্বীপ নয়। জাতীয় জীবনের সঙ্গে এর আন্তঃসম্পর্ক রয়েছে। দেশের সুনাম ক্ষুণ্ন ও উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করতে একটি গ্রুপ বিভিন্ন স্থানে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার বিষয়টি ভেবে হলেও ক্যাম্পাসে বাইরের মানুষের প্রবেশের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের সতর্ক হওয়া উচিত। আমাদের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়া উচিত। সমৃদ্ধ ভারত আর সোনার বাংলার গল্প শুনে সোনালি স্বপ্নে বিভোর ইউরোপীয়রা একদিন ভাস্কো দা গামার হাত ধরে আবিষ্কার করে ভারতে আসার পথ। তার পর বাকি গল্প কেবল আমাদের জন্য সর্বনাশের। অন্তত অনর্থক সুনামে মজে গিয়ে দেশের গুরুত্বপূর্ণ ও কাগজে-কলমে একমাত্র আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন সর্বনাশ ডেকে আনার সুযোগ নেই। প্রশাসনের উচিত এখনই সতর্ক পদক্ষেপ গ্রহণ করা। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক প্রতিবেশ আর শিক্ষার পরিবেশ অবাধ করতে বহিরাগতদের আগমন নিয়ন্ত্রণ এখন সময়ের দাবি। পাশাপাশি যারা বাইরে থেকে যাচ্ছেন, পুরো ক্যাম্পাস গাড়ি নিয়ে ঘুরে দূষিত করার বদলে উপযুক্ত গাড়ি পার্কিং ব্যবহারে তাদের বাধ্য করা উচিত। এক্ষেত্রে ক্যাম্পাস কর্তৃপক্ষ তাদের থেকে প্রয়োজনীয় টোল আদায় করার মধ্য দিয়ে উপকৃত হতে পারে। অন্যদিকে নির্দিষ্ট স্থানে গাড়ি রেখে পায়ে হেঁটে ভেতরে যাওয়ার ব্যবস্থা করে অহেতুক দর্শনার্থীর আগমনও কিছুটা কমিয়ে আনা সম্ভব।