মা-বাবার আত্মত্যাগ ও পরম স্নেহ-ভালোবাসায় দুর্বল ও পরনির্ভরশীল হয়ে জš§ নেওয়া শিশুটি একসময় আত্মনির্ভরশীল হয়ে ওঠে। একই সঙ্গে বাড়তে থাকে বাবা-মায়ের বয়স। সন্তান পড়াশোনা শেষে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে, তারপর বিয়ে করে সংসার শুরু করে। এ সময়ের মধ্যে বাবা-মা বৃদ্ধ হন। সদ্য জš§ নেওয়া শিশুটির মতো বয়সের ভারে তারাও দুর্বল ও পরনির্ভরশীল হয়ে পড়েন একসময়। বাবা-মায়ের এমন অসহায় অবস্থায় পরম স্নেহ-ভালোবাসায় লালিত সন্তান দায়িত্ব ও কর্তব্য ভুলে তাদের অনেকেই বোঝা ভাবতে শুরু করে। তখন শুরু হয় নতুন এক অধ্যায়। জীবনসায়াহ্নে শেষ দিনগুলো আর পরিবারের সবার সঙ্গে কাটানোর সৌভাগ্য হয় না। সন্তানের অবহেলা ও অযতেœ বৃদ্ধ বাবা-মায়ের শেষ ঠিকানা হয় বৃদ্ধাশ্রম।
বিশ্বের প্রথম বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রাচীন চীনে। গৃহছাড়া অবহেলিত ও অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্রের এ উদ্যোগ ছিল শান রাজবংশের। খ্রিষ্টপূর্ব ২২০০ শতকে পরিবার থেকে বিতাড়িত অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য আলাদা এ আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করে ইতিহাসের পাতায় বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছে শান রাজবংশ। প্রাচীন চীনে শান রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত বৃদ্ধাশ্রমের ধারণা বর্তমান বিশ্বে প্রসার লাভ করেছে।
বাংলাদেশে ডা. একেএম আবদুল ওয়াহেদের উদ্যোগে ১৯৬০ সালে প্রথম বার্ধক্যে সবার জন্য শারীরিক-মানসিক সুস্থতা ও অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের একটু স্বস্তিময় জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ ও জরাবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান। এরপর সরকারি উদ্যোগে ১৯৮৫ সালে ঢাকার আগারগাঁওয়ে নিজস্ব ভবন এবং পরে ১৯৯৩-৯৪ সালে সরকারি অনুদানে হাসপাতাল ও হোম ভবন নির্মাণ করা হয়। বর্তমানে দেশব্যাপী এ প্রতিষ্ঠানটির একাধিক শাখা রয়েছে। এছাড়া কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যেমন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী কল্যাণ সমিতি, ব্র্যাক, ইআইডি, প্রবীণ অধিকার ফোরাম প্রভৃতি প্রবীণদের কল্যাণে কাজ করে।
বৃদ্ধাশ্রম মূলত ওইসব প্রবীণের জন্য, যাদের সন্তানাদি নেই, নেই কোনো আত্মীয়স্বজন। জীবনসায়াহ্নে যেন তারা একাকিত্বে না ভোগে, সুন্দর একটা পরিবেশে যেন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারেন, এসবের জন্যই বৃদ্ধাশ্রম। কিন্তু বর্তমান বৃদ্ধাশ্রমে যেসব প্রবীণ বসবাস করেন, তাদের অধিকাংশেরই সন্তানাদি এবং আত্মীয়স্বজন আছেন। এসব প্রবীণ অধিকাংশই সন্তান কর্তৃক দুর্ব্যবহার কিংবা নির্যাতনের শিকার। ভালোবাসার প্রিয় সন্তান শ্রদ্ধাবোধ ও কর্তব্যবোধ হারিয়ে তাদের বৃদ্ধাশ্রমে রেখে গেছেন। অনেক সময় দেখা যায়, বিয়ের পর সন্তান, বউ, শ্বশুর-শাশুড়িকে নিয়ে সংসার পেতেছেন। ওই দিকে নিজের বাবা-মায়ের কোনো খোঁজখবর রাখেন না। আবার সন্তানের বউও শ্বশুর-শাশুড়িকে নিজের বাবা-মা ভাবতে পারেন না। অবশেষে বাবা-মায়ের জায়গা হয় বৃদ্ধাশ্রমে। বৃদ্ধাশ্রমে থাকা মানুষগুলোর শেষ বয়সে আর সন্তান, নাতি-নাতনিদের সঙ্গে বাস করার সৌভাগ্য হয় না। জীবনসায়াহ্নে ভালোবাসার মানুষগুলোর সঙ্গে যৌবনের আনন্দঘন মুহূর্ত রোমন্থন করা হয় না। অথচ সন্তানের আবদার পূর্ণ করতে এ মানুষগুলোই নিজেদের সুখ-শান্তি হাসিমুখে বিসর্জন দিয়েছেন, সন্তান অসুস্থ হলে সারা রাত জেগে থেকে সন্তানের সেবা করেছেন, সন্তানের আরোগ্য লাভের জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করেছেন, সন্তানের মঙ্গল কামনায় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে মানত করেছেন, সন্তানের মুখে ভালো খাবার তুলে দিতে গিয়ে অনেক সময় নিজেরা অনাহারে থেকেছেন, সন্তানের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য নিজেদের সব দুঃখ-কষ্ট ভুলে গেছেন। কিন্তু কী হƒদয়বিদারক, ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, শেষ বয়সে সব ত্যাগের বিনিময়ে তাদের স্থান হয় বৃদ্ধাশ্রমে!
পাশ্চাত্যে বৃদ্ধাশ্রম একেবারে স্বাভাবিক ঘটনা। ওইসব দেশে সন্তান প্রাপ্তবয়স্ক হলেই সে স্বাধীন, অনেকটা মা-বাবার নিয়ন্ত্রণমুক্ত। সে ইচ্ছা করলে প্রবীণ বাবা-মাকে দেখাশোনা করতে পারে, ইচ্ছা না হলে নেই। রাষ্ট্রীয় কিংবা সামাজিক কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। রাষ্ট্র প্রবীণদের মৌলিক অধিকারের বিষয়ে সতর্ক। উন্নত দেশের প্রবীণরা যাতে সুন্দর ও সচ্ছলভাবে, সুন্দর একটা পরিবেশে জীবনের শেষ দিনগুলো কাটাতে পারে, রাষ্ট্র তার ব্যবস্থা করে। পাশ্চাত্যে মা-বাবা যখন একেবারে বয়সের ভারে বৃদ্ধ তখন তাদের আশ্রয় প্রবীণ আবাসন কেন্দ্র তথা বৃদ্ধাশ্রম অথবা অনেকে থাকেন নিঃসঙ্গ। নিঃসঙ্গ প্রবীণদের নিত্যসঙ্গী হয়ে যায় কুকুর বা অন্য কোনো পোষা প্রাণী। একান্ত আপনজন ব্যস্ত সন্তানরা বৃদ্ধ মা-বাবাকে দেখতে যাওয়ার জন্য ‘মাদারস ডে’, ‘ফাদারস ডে’ পালন করে। এদিনে কিছু গিফট বা হাতে ফুল নিয়ে সন্তানরা বৃদ্ধ মা-বাবাকে দেখতে যান। বাবা-মাও ওইদিন তাদের সন্তানের অপেক্ষায় থাকেন। এ নিয়ে তাদের কোনো অভিযোগ নেইÑবরং এটাই যেন তাদের সংস্কৃতি। কিন্তু আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে এরূপ ধারণা কি সামঞ্জস্যপূর্ণ? আমরা তো পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে বড় হই না। আমরা বড় হই বাবা-মায়ের আদর, পরম মমতায় ভালোবাসার সুশীতল ছায়ায়।
দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশেও এ অপসংস্কৃতি দিন দিন যেন চালু হচ্ছে। আকাশ সংস্কৃতির কালো থাবা থেকে আমাদের সামাজিক ও নৈতিক দায়িত্ব ও মূল্যবোধ আজ আক্রান্ত। অপসংস্কৃতি গ্রাস করছে আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও ভালোবাসা তাই দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে।
ছোটবেলায় পরিবার থেকে একটা শিশু যে শিক্ষা লাভ করে তা তার সামগ্রিক জীবনকে প্রভাবিত করে। বলা হয়, পরিবার হচ্ছে শাশ্বত বিদ্যালয়। মুরুব্বিদের সামনে পা তুলে চেয়ারে না বসা, তাদের মুখে মুখে তর্ক না করা, যানবাহনে কোনো বয়স্ক মানুষ দাঁড়িয়ে থাকলে সিট ছেড়ে তাকে বসতে দেওয়া, মুরব্বিদের সামনে ধূমপান না করা, বয়স্কদের আদেশ-নিষেধ মেনে চলা এমন নানা সামাজিক শিক্ষা পরিবার থেকে দেওয়া হতো। এখন এসব শিক্ষা দেওয়া হয় কি না, জানি না। তবে স্কুল ড্রেস পরে ছোট ছেলেমেয়েরা যেভাবে প্রকাশ্যে নেশা করে, অসামাজিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকে, তাতে মনে হয় পরিবার থেকে এসব শিক্ষা উঠে গেছে। যুবসমাজের সামাজিক অবক্ষয় যে কতখানি ঘটেছে, তা একটা বিনোদন পার্কে ঘুরতে গেলেই দেখা যায়। আধুনিক যুগে এসে মানুষের মূল্যবোধ ও নৈতিকতা বাড়ার কথা, কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এগুলো বর্তমানে আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে।
আমাদের সমাজে একটি প্রবাদ বাক্য আছেÑযদি কিছু জানতে চাও, তিন মাথার কাছে যাও। এই তিন মাথা বলতে বোঝায় আমাদের প্রবীণ সমাজ। পারিবারিক কিংবা সামাজিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে মুরুব্বিদের মতামত নেওয়া হতো। সমাজ পরিবর্তনশীল। অবস্থার পরিবর্তন হবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যে পরিবর্তনটা এসেছে, সেটা খুবই অস্বাভাবিক। এ পরিবর্তনে শ্রদ্ধার জায়গায় অশ্রদ্ধা, ভালোবাসার জায়গায় ঘৃণা, সংস্কৃতির জায়গায় অপসংস্কৃতি দখল করেছে। নৈতিকতা ও মূল্যবোধের কোনো স্থান নেই। তাই পারস্পরিক বিশ্বাস, আস্থা ও শ্রদ্ধাবোধের জায়গাটা দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। ফলে প্রবীণ জনগোষ্ঠী আজ চরম দুঃখ-দুর্দশায়। অসহায় ও বঞ্চনার মধ্যে অতিবাহিত হচ্ছে তাদের জীবন।
প্রবীণদের সামাজিক নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করার জন্য জাতীয় সংসদে পিতা-মাতা ভরণপোষণ বিল-২০১৩ পাস করা হয়। বিলে বলা হয়েছে, প্রত্যেক সন্তানকে পিতামাতার সঙ্গে একই স্থানে বসবাস করতে হবে। কোনো সন্তান তার পিতা বা মাতাকে বা উভয়কে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বৃদ্ধনিবাস বা অন্য কোথাও বা আলাদাভাবে বসবাস করতে বাধ্য করতে পারবে না। প্রত্যেক সন্তানকে তার পিতামাতার স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজখবর রাখতে হবে। প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা ও পরিচর্চা করবে। তারা পৃথকভাবে বসবাস করলে সন্তানদের নিয়মিত সাক্ষাৎ করতে হবে। এ-সংক্রান্ত অপরাধের জন্য এক লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে সর্বোচ্চ তিন মাসের জেলের বিধান রাখা হয়েছে। পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে সরকার এ আইন পাস করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, আইন করে প্রবীণদের প্রতি সব বঞ্চনা, অবহেলা ও বৈষম্য দূর করা কি সম্ভব? মানুষের গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ায় প্রবীণদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। প্রাপ্ত তথ্যমতে, দেশে এখন এক কোটি ২৫ লাখের বেশি প্রবীণ রয়েছেন। ধারণা করা হচ্ছে, এ হারে ২০২৫ সালে এ সংখ্যা এক কোটি ৮০ লাখ হবে প্রায়। ভালোবাসা, শ্রদ্ধাবোধ, কর্তব্যবোধ আসলে আইন পাস করে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন সবার মধ্যে নৈতিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তন। ক্রমবর্ধমান প্রবীণ জনগোষ্ঠীর অধিকারের ভিত্তিতে স্বার্থ সংরক্ষণ করতে হলে শিশু ও কিশোর বয়সে সন্তান-সন্ততিকে সততা, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের শিক্ষা দিতে হবে। আজকের নবীন ভবিষ্যতের প্রবীণ। আজ যে ব্যক্তি তার মা-বাবাকে অসম্মান করবে, বৃদ্ধ বয়সে সেও তার সন্তানের কাছে অনুরূপ আচরণ পেতে পারেÑএটা সবারই মনে রাখা উচিত।
লেখা শেষ করব বাগেরহাট জেলার মোড়লগঞ্জ থানার চণ্ডিপুর গ্রামের বাসিন্দা বীরেন্দ্রনাথ মজুমদারের মাতৃভক্তির সেই গল্প বলে। (এখানে দেখতে পাবেন যঃঃঢ়ং://স.ুড়ঁঃঁনব.পড়স/ধিঃপয?া=ঢাএঐছ৫ঁড়৪িও) বার্ধক্যজনিত নানা অসুখে বীরেন্দ্রনাথের মা অসুস্থ। তিনি সার্বক্ষণিক তার মায়ের সেবা-যতœ করেন। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে মাকে টুকরির মধ্যে বসিয়ে মাথায় করে ১০ মাইল পাড়ি দিয়ে ডাক্তারের কাছে নিয়ে আসেন। জানি না তার মা আজও বেঁচে আছেন কি না। দরিদ্র বীরেন্দ্রনাথের মাতৃভক্তির এ নিদর্শন থেকে আমাদের অনেক কিছুই শেখার আছে। বৃদ্ধাশ্রম নয়, পরিবারই হোক বাবা-মায়ের নিরাপদ আবাস। ডিজিটাল যুগের ইট-পাথরের পরিবেশেও অটুট থাকুক মিহি সুতায় বাঁধা পরিবারের স্নেহ-ভালোবাসার বন্ধন, শ্রদ্ধা ও মর্যাদা।